ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর প্রথম মহান বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের অর্থনীতির চরম বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন। আজ সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) সকাল ১০টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া এই ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডে সম্প্রচারিত হয়। ড. ইউনূস তাঁর ভাষণে অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন উল্লেখ করে বলেন, “এ প্রতিবেদন পড়ে দেশের মানুষ হতভম্ব হয়ে গেছে।”
ড. ইউনূস উল্লেখ করেন যে, শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরিমাণ প্রকাশিত হয়েছে, যা দেশের মানুষের কল্পনার বাইরে। তিনি বলেন, “দিনদুপুরে সবার সামনেই হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে পাচার করা হয়েছে। কারও মুখে কোনো কথা ছিল না, বরং সব স্তরে এই লুটপাটে সহযোগিতা করা হয়েছে।”
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঋণের টাকায় নেওয়া প্রকল্পের আড়ালে ব্যাপক অর্থ লুটপাট, বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় অর্ধেকই লুটপাট, নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে অতিরিক্ত করছাড়, যা শিক্ষার বাজেট দ্বিগুণ এবং স্বাস্থ্য বাজেট তিনগুণ করার সুযোগ নষ্ট করেছে।
ড. ইউনূস বলেন, “পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনাই এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এ ব্যাপারে আইন জটিল হওয়ায় কাজটা কঠিন।” তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই আংশিক হলেও এই অর্থ ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিদেশে পাচার করা টাকায় গড়ে ওঠা সম্পদের চিত্র উঠে এসেছে। তিনি সতর্ক করেন, পাচারকৃত অর্থ দেশের মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টি করতে ব্যবহৃত হতে পারে।
ড. ইউনূস বলেন, “আমাদের প্রধান লক্ষ্য অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা এবং মানুষের জীবনমান উন্নয়ন।”
তিনি অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতির তথ্য তুলে ধরে বলেন, ২০২৪ সালের নভেম্বরে রপ্তানি আয় ছিল ৪১২ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের মাসের তুলনায় ১৫.৬৩% বেশি। ২০২৪ সালের জুলাই-নভেম্বর সময়ে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ১৬১১ কোটি মার্কিন ডলারে। রিজার্ভ বেড়ে হয়েছে ১৯০০ কোটি মার্কিন ডলার।
তবে তিনি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে না পারার কথাও স্বীকার করেন। বাজারে দ্রব্যের মূল্য সহনীয় রাখতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে সরবরাহ বাড়ানো, আমদানিতে শুল্ক ছাড় এবং বাজার তদারকি উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি পোশাকশিল্প সম্পর্কে ড. ইউনূস বলেন, শ্রমিকদের বার্ষিক মজুরি ৯% বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় শ্রমিক ইউনিয়ন ও মালিক পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ড. ইউনূস জনগণের উদ্দেশে বলেন, “পাচারকৃত অর্থ আপনাদেরই। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে যদি কেউ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করে, তাকে কঠোরভাবে দমন করা হবে।”
তিনি আরও বলেন, বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমাতে বিকল্প কৃষিবাজার চালু করার লক্ষ্যে কাজ চলছে। আসন্ন রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
ড. ইউনূস ঘোষণা দেন যে ২০২৫ সালের শেষ থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটি কার্যকর ব্যবস্থা প্রবর্তনে কাজ করে যাচ্ছে।”
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই ভাষণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে গৃহীত নানা পদক্ষেপ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার দিকনির্দেশনা উঠে এসেছে। দেশের জনগণের জন্য এটি ছিল আশা ও দায়িত্ববোধের এক তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা।