বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়া নিয়ে একের পর এক বিতর্ক এবং সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। গত বছর মার্চ থেকে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণী পদ্ধতি চালু হলেও, এর বাস্তবায়ন সঠিকভাবে না হওয়ায় সাধারণ জনগণ আশা পূর্ণভাবে দেখতে পায়নি। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের ফলে জ্বালানির দাম কমে আসবে বলে আশা করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং এই সময়ে জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা করতে দেখা গেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত তিন দফায় জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। প্রথম দফায়, ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট অকটেন ও পেট্রলের দাম লিটারে ছয় টাকা কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর, দ্বিতীয় দফায় ৩১ অক্টোবর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম শূন্য দশমিক ৫ টাকা কমানো হয়, তবে পেট্রল ও অকটেনের দাম অপরিবর্তিত থাকে। সর্বশেষ, ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির (২০২৪) পরিচালিত গবেষণামতে, এই মূল্য সমন্বয় আন্তর্জাতিক বাজারভিত্তিক মূল্য কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সিপিডির মতে, সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে জ্বালানি তেলের দাম আরও কমানো সম্ভব, এমনকি প্রতি লিটার ১০ থেকে ১৫ টাকা কমানো যেতে পারে।
স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণী পদ্ধতির প্রথম চালু হওয়ার উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে জ্বালানি খাতে সরকারের আর্থিক দায় কমানো। তবে, বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) এবং বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন) এর মূল্য নির্ধারণী পদ্ধতিগুলোর মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে, যা প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব বিইআরসির পরিবর্তে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের হাতে দেওয়া হয়েছে। সিপিডির গবেষণায় দেখা যায় যে, বিইআরসি এবং বিপিসির ব্যবহৃত পদ্ধতিতে এক্সচেঞ্জ রেটের (ডলার-টাকা বিনিময় হার) সমন্বয় করা হয়নি, ফলে কিছু সময়ের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশে তা মূল্যবৃদ্ধি ঘটায়।
এছাড়াও, বিপিসির মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে ৬ ধাপে কর এবং ভ্যাট আরোপ করা হয়, যা বিইআরসির পদ্ধতিতে মাত্র ২ ধাপে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এর ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একই নীতিমালার অধীনে দুটি ভিন্ন ধরনের কর-ভ্যাট ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, যা বিপিসির পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সিপিডি, তাদের প্রস্তাবিত মূল্য নির্ধারণী পদ্ধতিতে আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেছে, যাতে গ্রাহকদের চাহিদা, ক্রয়ক্ষমতা এবং সরবরাহকারীদের খরচ, উৎপাদন খরচের বিষয়গুলোকে সমন্বয় করা হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে জ্বালানি তেলের মূল্য আরও কমানো সম্ভব, যেমন সিপিডির প্রস্তাবনায় প্রতি লিটার পেট্রল ও অকটেনের দাম ৬ টাকা এবং ডিজেলের দাম ১০ টাকা কমানো যেতে পারে।
বিপিসি বেশ কয়েক বছর ধরে ক্রমবর্ধমানভাবে মূল্য সমন্বয়ের মাধ্যমে এবং লাভের মাধ্যমেও ক্ষতি সামঞ্জস্য করে আসছে। তবে, বিপিসির উর্ধ্বমুখী মূল্য সংশোধনের মাধ্যমে যে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, তা সাধারণ জনগণের জন্য অগ্রহণযোগ্য।
যদি বিইআরসি কর্তৃক গৃহীত মূল্য নির্ধারণী পদ্ধতির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং প্রক্রিয়া সংশোধন করা হয়, তবে তা বাংলাদেশের জ্বালানি খাতকে একটি কার্যকর ও স্বচ্ছ ব্যবস্থা প্রদান করবে। পাশাপাশি, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি সংশোধন করে ভোক্তাদের কাঁধে বাড়তি ব্যয়ের চাপ কমানো সম্ভব হবে।
এছাড়া, সিপিডির প্রস্তাবিত মূল্য নির্ধারণী পদ্ধতি গ্রাহকদের আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব না ফেললেও বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সামগ্রিকভাবে কমবে এবং উৎপাদন ব্যয়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বর্তমান জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে কিছু বড় সমস্যা রয়েছে, যা সংশোধন করা প্রয়োজন। সিপিডির প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে অনেক সুবিধা রয়েছে, এবং এটি বাস্তবায়িত হলে ভোক্তাদের জন্য ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।