গতকাল মঙ্গলবার আর্কটিক অঞ্চলের দ্বীপ গ্রিনল্যান্ডে পৌঁছেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র। এই দ্বীপ নিয়ে সম্প্রতি তার বাবা, যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া বিবৃতি বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করেছে। ট্রাম্প দ্বীপটি কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও গ্রিনল্যান্ড কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে দ্বীপটি বিক্রির জন্য নয়।
গ্রিনল্যান্ড সফরকে ট্রাম্প জুনিয়র ‘খানিকটা আনন্দভ্রমণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘বাড়ির বাইরে সময় কাটানোর মানুষ হিসেবে এ সপ্তাহে গ্রিনল্যান্ডে থামতে পেরে আমি রোমাঞ্চিত।’ তবে তার এই সফর নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। ধারণা করা হচ্ছে, দ্বীপটি নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই সফর হতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরই গ্রিনল্যান্ডের মালিকানা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে দ্বীপটির মালিকানা জরুরি বলে উল্লেখ করেন। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দ্বীপটির প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার ও কৌশলগত অবস্থানই এর প্রতি ট্রাম্পের আসল আগ্রহের কারণ।
গ্রিনল্যান্ড বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ। এর জনসংখ্যা মাত্র ৫৬ হাজারের কিছু বেশি। ডেনমার্কের সাবেক উপনিবেশ হওয়া সত্ত্বেও এটি এখন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। দ্বীপটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মাঝখানে অবস্থিত। এর রাজধানী নুক শহরটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের তুলনায় ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের চেয়ে বেশি নিকটবর্তী।
‘ড্যানিশ ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’-এর জ্যেষ্ঠ গবেষক আলরিক প্রাম গাদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই গ্রিনল্যান্ডের মালিকানাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে আসছে। বিশেষ করে রাশিয়ার সম্ভাব্য হামলা ঠেকানোর জন্য দ্বীপটির ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি।
গ্রিনল্যান্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে তেল, গ্যাস এবং পৃথিবীর বিরল কিছু ধাতু। এগুলো বৈদ্যুতিক গাড়ি, বায়ুকল এবং সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বরফ গলে যাওয়ার কারণে গ্রিনল্যান্ড থেকে এই সম্পদ আহরণ আরও সহজ হয়ে উঠতে পারে।
রয়্যাল হলোওয়ে, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ভূরাজনীতির অধ্যাপক ক্লাউস ডডস বলেন, ‘ট্রাম্পের কাছে গ্রিনল্যান্ড আরও আকর্ষণীয় হওয়ার কারণ হতে পারে দ্বীপটির প্রাকৃতিক সম্পদের মজুত। এ দ্বীপ থেকে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ আহরণ করা সম্ভব, যা বৈদ্যুতিক গাড়ি ও সামরিক সরঞ্জাম তৈরির জন্য প্রয়োজন।’
ফ্লোরিডায় ট্রাম্পের এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি কি পানামা খাল ও গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ পেতে সামরিক বা অর্থনৈতিক বল প্রয়োগ করবেন? জবাবে ট্রাম্প স্পষ্ট করে বলেছেন, তিনি কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না। তিনি বলেন, ‘(যুক্তরাষ্ট্রের) অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় আমাদের ওই দুটিই প্রয়োজন।’
ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নন, যিনি গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব দিয়েছেন। ১৮৬৭ সালে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসন আলাস্কা কেনার সময় গ্রিনল্যান্ড কেনার বিষয়টি বিবেচনায় এনেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের প্রশাসন ডেনমার্ককে ১০ কোটি মার্কিন ডলার দিয়ে গ্রিনল্যান্ড কিনতে চেয়েছিল। যদিও সেই প্রস্তাব কার্যকর হয়নি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আর্কটিক অঞ্চলে বরফ দ্রুত গলছে। এতে নতুন জাহাজ চলাচলের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে। আর্কটিক কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, গত দশকে আর্কটিকে জাহাজ চলাচল ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বরফ গলে যাওয়ায় প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ আরও সহজ হয়ে উঠছে।
অধ্যাপক ফিলিপ স্টেইনবার্গ বলেন, ‘বরফ গলতে থাকলে গ্রিনল্যান্ড থেকে প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ সহজতর হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত জলবায়ু সংকট এ ব্যাপারে মোড় ঘোরানো কোনো সুযোগ এনে দেয়নি।’
বিশ্বের বিরল খনিজ উৎপাদনে চীন এগিয়ে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের আগেই চীন থেকে খনিজ ও প্রযুক্তি রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপের হুমকি দিয়েছে। অধ্যাপক ডডস বলেন, ‘চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে ট্রাম্প ও তাঁর উপদেষ্টারা খুবই উদ্বিগ্ন। গ্রিনল্যান্ড এসব গুরুত্বপূর্ণ খনিজের একটি সম্ভাব্য সমৃদ্ধ ভান্ডার।’
ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড কেনার আকাঙ্ক্ষার ভবিষ্যৎ কী হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ড্যানিশ ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রাম গাদ বলেন, ‘এটি কি শুধুই ট্রাম্পের সাহসিকতা প্রদর্শন, নাকি বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা—তা এখনো কেউ জানে না।’