ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে হাসপাতাল থেকে হঠাৎ এক ফোনকল, ঢাকায় আন্দোলনরত ছাত্রনেতাদের আহ্বান এবং দেশে ফেরার নাটকীয় মুহূর্ত—এই ঘটনাগুলোই অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার নেপথ্যের গল্প। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সময় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের বৈদেশিকবিষয়ক প্রধান ভাষ্যকার গিডেয়েন রাখমানের পডকাস্ট ‘রাখমান রিভিউ’-তে তিনি এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন।
অধ্যাপক ইউনূস জানান, তিনি যখন প্রথম ফোনকল পান, তখন প্যারিসের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ছোট্ট একটি অস্ত্রোপচারের পর সেরে উঠছিলেন। হঠাৎ ছাত্রনেতারা তাঁকে ফোন দিয়ে বলেন, "শেখ হাসিনা চলে গেছেন। এখন আমাদের সরকার গঠন করতে হবে। দয়া করে, আমাদের জন্য সরকার গঠন করুন।"
এমন আকস্মিক অনুরোধে তিনি হতবাক হন এবং সরাসরি জানান, "আমি সেই ব্যক্তি নই। আমি এসব বিষয়ে কিছু জানি না এবং যুক্ত হতেও চাই না।" কিন্তু ছাত্রনেতারা নাছোড়বান্দা ছিলেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তিনি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে বাংলাদেশে অনেক ভালো নেতা আছেন, তাদের খুঁজে নেওয়া উচিত। কিন্তু ছাত্রনেতারা বলেন, "না, আপনাকেই থাকতে হবে। আমরা কাউকে পাইনি।"
তখন তিনি বলেন, "তোমরা অন্তত ২৪ ঘণ্টা চেষ্টা করো। ভালো নেতা না পেলে আমাকে আবার ফোন করো।"
একদিন পর ছাত্রনেতারা আবার ফোন করে জানান, "আমরা অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু সম্ভব হয়নি। আপনাকে অবশ্যই দেশে ফিরতে হবে।"
এ পর্যায়ে অধ্যাপক ইউনূস ভাবেন, “তারা রাজপথে জীবন দিয়েছে, প্রচুর রক্ত ঝরিয়েছে। তারা যদি এত কিছু করতে পারে, তাহলে আমারও কিছু করা উচিত।" তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নতুন সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের জন্য তিনি রাজি আছেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, কিছুক্ষণ পর হাসপাতালের একজন নার্স তাঁকে ফুলের তোড়া উপহার দেন এবং বলেন, "আপনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, আমরা এটা জানতাম না!"
তখন তিনি বিস্মিত হয়ে জানতে চান, নার্স এটা কোথা থেকে জানলেন? তখন নার্স বলেন, "সব গণমাধ্যম ও টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার হচ্ছে যে আপনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী!"
এরপর হাসপাতালের বোর্ড সদস্যরা আসেন, তাঁকে নতুন ‘প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে শুভেচ্ছা জানান এবং বলেন, "বিকেলের আগে আপনাকে হাসপাতাল ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হবে না।"
অধ্যাপক ইউনূস হাসপাতাল পরিচালককে বলেন, "ছাত্রনেতারা আমাকে দেশে যেতে বলছে, আমি কি ভ্রমণের জন্য প্রস্তুত?" তখন পরিচালক বলেন, "অবশ্যই, আপনি একজন প্রধানমন্ত্রী। আপনার নিরাপদ যাত্রার জন্য আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নেব।"
এরপর, কয়েক ঘণ্টা পর ফরাসি সেনাবাহিনীর বড় একটি দল তাঁকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিতে আসে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, "এটাই ছিল দেশে ফেরার আগের ঘটনাবলি।"
বাণিজ্যিক উড়োজাহাজে যাত্রা করার সময় আন্দোলনকারী ছাত্রনেতারা ইতোমধ্যেই নতুন সরকারের রূপরেখা দাঁড় করিয়ে ফেলেছিল। বিমানবন্দরে পৌঁছে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং সবাইকে ধৈর্য, শান্তি ও একতা বজায় রাখার আহ্বান জানান।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের এই অভিজ্ঞতা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে থাকবে। এক ফোনকল থেকে শুরু হয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তুতি, ছাত্রনেতাদের অনুরোধ, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া ও দেশে ফেরার নাটকীয় মুহূর্ত—সব মিলিয়ে এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক সময়ের ঘটনা।