ফৌজদারি অপরাধের মামলা তদন্তে থানা-পুলিশের পাশাপাশি সিআইডি ও পিবিআই কাজ করছে। তবে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন মনে করছে, প্রভাবমুক্ত ও দক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে পুলিশের বাইরে একটি সম্পূর্ণ নতুন ও স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠন করা প্রয়োজন। কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে এই প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে এবং এটি সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
বর্তমানে ফৌজদারি মামলা তদন্ত করে থানা-পুলিশ। পাশাপাশি সিআইডি ও পিবিআই’র মতো বিশেষ ইউনিট রয়েছে। তবে এসব ইউনিট পুলিশের অধীনে পরিচালিত হয়। কমিশনের প্রস্তাবিত নতুন তদন্ত সংস্থার জনবল হবে পুলিশ বাহিনী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের নিয়োগ, চাকরির শর্ত, বাজেট, অবকাঠামো সবকিছু স্বতন্ত্রভাবে নির্ধারিত হবে। তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট অ্যাটর্নি বা প্রসিকিউটরের তত্ত্বাবধানে কাজ করবেন।
নতুন সংস্থার মূল কাজ হবে মামলা দায়েরের পর তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা। সংস্থার জনবল পুলিশ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হবে, নিয়োগ ও বাজেট সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হবে, তদন্ত কর্মকর্তারা প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবেন এবং অ্যাটর্নি সার্ভিসের তত্ত্বাবধানে থাকবেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, "পুলিশকে বহু ধরনের কাজ করতে হয়। যদি আলাদা করে একদল শুধু তদন্তের জন্য নিয়োজিত থাকে, তাহলে তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বাড়বে। তদন্ত সঠিক ও যথার্থ হবে।"
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন। বর্তমানে অ্যাটর্নি জেনারেলসহ অন্যান্য আইন কর্মকর্তারা মূলত অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পান এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিশন মনে করে, এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন করা জরুরি।
অ্যাটর্নি সার্ভিস হবে একটি স্থায়ী সরকারি চাকরি, সুনির্দিষ্ট নিয়োগপদ্ধতি, পদোন্নতি, বদলি, বেতন কাঠামো এবং শৃঙ্খলা সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হবে। অ্যাটর্নি সার্ভিসের দুটি ইউনিট থাকবে, সুপ্রিম কোর্ট ইউনিট (অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল), জেলা ইউনিট (অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি, ডেপুটি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি এবং ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি)।
শাহদীন মালিক বলেন, "বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস রয়েছে। বাংলাদেশে ল ক্যাডার সার্ভিস না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আইন কর্মকর্তাদের রদবদল হয়। এতে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি দেখা যায়।"
প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিথ্যা মামলা দেশের বিচারব্যবস্থার জন্য একটি বড় সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রে নির্দোষ ব্যক্তিদের হয়রানি করা হয় এবং প্রকৃত অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা যায়, দেশে সর্বোচ্চ ঘুষ গ্রহণকারী পাঁচটি খাতের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা একটি। পুলিশের কিছু সদস্যের দুর্নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশের ওপর একধরনের ভীতি কাজ করে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, "গোটা পৃথিবীতে পুলিশ ফৌজদারি মামলার তদন্ত করে। তবে ফ্রান্সে ম্যাজিস্ট্রেটদের তদন্তের উদাহরণ রয়েছে। আমরা সিআইডি, পিবিআই ও দুদকের মতো সংস্থা করেছি। এরপরও কেন নতুন সংস্থার প্রয়োজন হবে, সেটি পরিষ্কার নয়।"
তবে আইনজীবীরা বলছেন, দেশে ফৌজদারি মামলায় দোষী প্রমাণিত হওয়ার হার মাত্র ২০ শতাংশ। ৮০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়। এর প্রধান কারণ হলো তদন্তের ঘাটতি। একেকজন পুলিশ কর্মকর্তা বহু মামলা নিয়ে কাজ করেন এবং তদন্তের জন্য যথেষ্ট সময় পান না। রাজনৈতিক প্রভাব ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগও রয়েছে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন মনে করে, একটি স্বতন্ত্র, দক্ষ, নির্ভরযোগ্য ও প্রভাবমুক্ত তদন্ত সংস্থা গঠনের মাধ্যমে দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। পাশাপাশি, একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন হলে মামলার তদন্ত থেকে শুরু করে বিচারপ্রক্রিয়া পর্যন্ত সব ধাপ আরও কার্যকর ও স্বচ্ছ হবে।
তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো