সুলতানা নাহার—একজন আইনজীবী, কবি, এবং টেবিল টেনিস খেলোয়াড়—এই নামটি শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ও পরিচিত। তাঁর পরিচয় অনেক স্তরে বিস্তৃত। তিনি একসময় সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন, তবে তাঁর জীবনের নানা দিকই তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ৭৯ বছরের এই মহিলার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন উদ্যাপনের গল্প, যেখানে সাহস, মনোবল এবং ব্যক্তিগত স্বপ্নের জয়গান রয়েছে।
সুলতানা নাহার এখন শ্রীমঙ্গলের রাধানগরে বাস করছেন, যেখানে প্রকৃতির সান্নিধ্যে তাঁর জীবন কাটে। রাজধানী ঢাকার শ্যামলীর নিজস্ব বাড়ি ছেড়ে তিনি এখানে আসেন শ্রীমঙ্গলের নির্জনতা এবং শান্তির খোঁজে। শীতের রাতে, যখন কুয়াশার মাঝে ঘন সুরে মোহাম্মদ রফির গজল বাজতে থাকে, তখন সুলতানা নাহার তাঁর কটেজের ঘরে বসে থাকা, লেখালেখি করা, অথবা চায়ের কাপ হাতে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা যেন এক প্রশান্তির অনুভূতি।
৭৯ বছর বয়সে এসে সুলতানা নাহার রিসোর্ট ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। বয়সের প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে তিনি নিজের ইচ্ছার পূর্ণতা খোঁজেন। তাঁর ‘হারমিটেজ’ রিসোর্ট এখন শ্রীমঙ্গলের অন্যতম জনপ্রিয় স্থান। ছোট্ট এক কটেজ দিয়ে শুরু হলেও, তাঁর উদ্যোগের পরিধি ক্রমে বাড়তে থাকে। ‘নিসর্গ নীরব ইকো কটেজ’—এটি এখন স্থানীয়দের এবং বিদেশি অতিথিদের কাছেও পরিচিত। এই রিসোর্টে আসেন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বরাও, যেমন মার্কিন কথাসাহিত্যিক জন সিলভার।
সুলতানা নাহারের জীবনের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি এক মুহূর্তেই ধারণ করা একটি ছবি, যা তাঁর মা হওয়ার পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তোলা হয়েছিল। তাঁর ভাষায়, “ছেলে হওয়ার পর গরম পানিতে গোসল করে চুল শুকাতে বসেছিলাম। আমার ভাই ক্যামেরায় এই ছবিটি তুলে ফেলেছিল।” এমন ছোট ছোট স্মৃতি তাঁকে আজও শক্তি ও প্রেরণা দেয়। তাঁর সন্তানেরা বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু সুলতানা নাহার কখনোই তাদের থেকে পিছিয়ে যাননি।
সুলতানা নাহারের মতে, বয়সের সংখ্যা কোনো বাধা হতে পারে না। “বয়স শুধু সংখ্যা—কথাটা একদম ভুল। সময়, শক্তি সবই শরীরে প্রভাব ফেলে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে মানুষের মন। নারী বলে, মেয়ে বলে পারব না—এই ভাবনা আপনাকে যতটা দুর্বল করে দেবে, বয়স তা পারবে না। আমি সব সময়ই একটু খ্যাপাটে ছিলাম; যা করতে চাই, তা শুরু করতে দুবার ভাবি না। ব্যর্থ হওয়া, সফল হওয়া—সেসব পরের কথা।”
আজকের সুলতানা নাহার শুধু একজন উদ্যোক্তা, কবি, আইনজীবী নন, তিনি এক শক্তিশালী নারী প্রতীক। একদিকে তাঁর জীবনের নানা দিকের সফলতা, অন্যদিকে অসাধারণ উদ্যম—তিনি প্রমাণ করেছেন যে কোনো বয়সে, কোনো অবস্থাতেই নিজের ইচ্ছা এবং লক্ষ্য পূরণের পথ বন্ধ হয় না। তাঁর রিসোর্টের নাম ‘হারমিটেজ’—এটি যেন তাঁর জীবন এবং অনন্য পথচলার প্রতীক, যেখানে একে একে তিনি সবকিছু করেছেন নিজের চেষ্টায় এবং শক্তিতে।
এভাবে সুলতানা নাহারের জীবন আমাদের শেখায় যে, ইচ্ছাশক্তি এবং সাহস দিয়ে আমরা যে কোনো পরিস্থিতি জয় করতে পারি।
তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো