বিশ্ব ইতিহাসে স্বৈরশাসকদের শাসনকাল কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। প্রায় সকল স্বৈরশাসকই জনগণের প্রশংসা এবং জনপ্রিয়তার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন, কিন্তু শেষে তাদের বিদায় ঘটে অপমান, লাঞ্চনা, এবং অভিশাপের মধ্যে। এমনকি তারা তাদের মূর্তি তৈরি করে রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্থাপন করে, কেবলমাত্র তাদের জন্য একটি আত্মতুষ্টির ইচ্ছা পূরণ করতে চান, তবে তাদের শাসন কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না, কারণ ইতিহাসে তাদের নামটি গুলিয়ে ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
বর্তমানে, বিশ্বে প্রায় ৫০টি দেশ রয়েছে, যেখানে স্বৈরশাসকরা ক্ষমতায় বসে আছেন, এবং এর মধ্যে বেশিরভাগ দেশই খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ, কিন্তু অর্থনৈতিক দিক থেকে হতভাগ্য। আফ্রিকা মহাদেশের ২২টি দেশে এখনও স্বৈরশাসকরা তাদের শাসন চালিয়ে যাচ্ছে, যেখানে জনগণের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা প্রায় বিপন্ন। এই প্রতিবেদনটি সেই স্বৈরশাসকদের কর্মকাণ্ড, তাদের শাসনকালে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ অবস্থা এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশে তাদের শাসন সম্পর্কে আলোচনা করবে।
স্বৈরশাসকদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো তারা সেনাবাহিনী থেকে উঠে এসে ক্ষমতায় বসেন এবং জনগণের মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেন। তবে, কিছুদিন পরেই তারা জনগণের মৌলিক অধিকারকে উপেক্ষা করে নিজের শাসনকে আরও শক্তিশালী করার জন্য অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তারা জনগণকে আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, কিন্তু পরে জনগণের আশা ও বিশ্বাস ভঙ্গ করেন।
যেমন, আফ্রিকার দেশগুলোতে স্বৈরশাসকরা একদিকে দেশের উন্নতির কথা বলেন, অন্যদিকে তারা নিজেদের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য দেশটির সম্পদ লুটে নিয়ে চলেছেন। উদাহরণস্বরূপ, উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইয়াওরি মুসেভেনি, ১৯৮৬ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন। তার মতো আরও অনেক নেতা আছেন যারা দশক ধরে এককভাবে ক্ষমতায় রয়েছেন।
স্বৈরশাসকদের মধ্যে কিছু নেতার প্রতি বিশেষভাবে ঘৃণা এবং নিন্দা লক্ষ্য করা যায়, যাদের শাসন কোনো ধরনের উন্নতি বা মানুষের কল্যাণের দিকে নয়, বরং নিজস্ব ক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে। প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস সেই উদাহরণ, যাকে এককথায় পুতুল শাসক বলা যেতে পারে। তার শাসন ছিল প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতার থেকে অনেক দূরের একটি পরিস্থিতি।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টিতে, কিছু স্বৈরশাসক তাদের নিজ দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে গেলেও, তাদের শাসন ধীরে ধীরে স্বৈরাচারের রূপ নিতে থাকে। যেমন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ান, যারা নিজেদের দেশকে শক্তিশালী করেছেন, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিতে তাদের শাসন একে অপরকে সমালোচিত হয়েছে। তাদের স্বৈরাচারী কৌশল বিশ্বের মোড়লদের কাছে সমালোচিত হলেও, তারা নিজেদের দেশে জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন।
লিবিয়ার গাদ্দাফি একসময় তার দেশের জন্য অসাধারণ কাজ করেছিলেন, কিন্তু তার শাসন শেষে তিনি বিশ্বের কাছে এক নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক হিসেবে পরিগণিত হন। গাদ্দাফি তার দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং জনগণের জন্য অবদান রেখেছিলেন, কিন্তু ক্ষমতার প্রতি তার অতৃপ্তি তাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
স্বৈরশাসকদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রকৃত উদাহরণ হলো বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক শাসকরা জনগণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসলেও, পরবর্তীতে তারা স্বৈরাচারী পদক্ষেপ নিয়েছেন। নির্বাচনী ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা পর্যন্ত, সব কিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণের আওতায় চলে আসে। এই ধরনের শাসনকালে জনগণের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় এবং দেশটির গণতন্ত্রের পতন ঘটে।
প্রকৃত স্বৈরশাসকদের উদাহরণ হিসেবে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ধরা যায়। তিনি তার শাসনকাল শুরু করেছিলেন উন্নতি এবং শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে, কিন্তু তার শাসনকাল দেশটিকে নৃশংস গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। তার শাসনকালে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ নিহত এবং দেশটির অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা চরম অবনতির দিকে চলে যায়।
স্বৈরশাসকরা ইতিহাসে এক ধরনের কালো দাগ হয়ে থাকে। তারা ক্ষমতায় এসে জনগণের মনে উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং পরিবর্তনের আশা জাগান, কিন্তু শাসনকালে তাদের কর্মকাণ্ড যে কতটা জঘন্য এবং কষ্টকর হতে পারে, তা কোনোদিনই ধারণা করা যায় না। ইতিহাসের মর্মমূলে গিয়ে তাদের প্রতি জনগণের অনুভূতি একটাই — বিদায় হয়ে যাও। শাসনক্ষমতার জন্য নিজের দেশের সামগ্রিক উন্নতির বিপরীতে তারা ব্যক্তিগত ক্ষমতা এবং স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেন, যা শেষ পর্যন্ত তাদের পতন ঘটায়।