বাংলাদেশের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি বাস্তবভিত্তিক ও টেকসই বাজেট তৈরির পরিকল্পনা করছে। দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের সংকট এবং শেয়ারবাজারে নিম্নমুখী প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে এই বাজেট দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চলতি অর্থবছরের তুলনায় পরবর্তী বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও তা হবে বেশ বাস্তবমুখী ও প্রয়োজনভিত্তিক।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এই বাজেটের আকার হবে সাড়ে ৮ লাখ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ইতোমধ্যে বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক শুরু হবে, যেখানে বিভিন্ন খাতের প্রস্তাব ও সুপারিশগুলো বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই বাজেট জাতীয় সংসদ না থাকায় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে ঘোষিত হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। শীত মৌসুমে শাকসবজির দাম কিছুটা কম থাকলেও বছরের অন্যান্য সময়ে খাদ্যদ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকার কিছু নীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। তবে অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হানের মতে, মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা খুবই আশাবাদী এবং বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
মার্কিন ডলারের সংকট পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কিছুটা ভালো হলেও সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এখনো আসেনি। এ কারণে সরকারকে বিদেশি ঋণের ওপর কিছুটা নির্ভর করতে হবে।
আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প পরিহার করে এমন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে, যা টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। দেশীয় অর্থায়নের চেয়ে বিদেশি অর্থায়নে বেশি নজর দেওয়া হবে।
সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বেতন ও মহার্ঘ ভাতা বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এই খাতে ৮২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। তবে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার ঘোষণা অনুযায়ী আগামী বাজেটে আরও বাড়তি বরাদ্দ থাকতে পারে।
আগামী বাজেটে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য সরকার কিছু নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে। আমদানি পণ্যে শুল্ক কমানোর ফলে রাজস্ব ঘাটতি পূরণে কিছু পণ্যে নতুন করে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আজ রোববার এ বিষয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করার কথা রয়েছে।
আগামী বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হতে পারে ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রস্তাবিত এডিপি থেকে বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে বরাদ্দ কমিয়েছে। নতুন বাজেটে এডিপির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হবে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের বাজেট বক্তৃতায় ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের অবদানের স্বীকৃতি থাকবে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশন ও কমিটিগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে। বাজেট বক্তৃতায় আর্থিক স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগ আকর্ষণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হবে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেছেন, আগামী বাজেট বাস্তবভিত্তিক হওয়া উচিত। সরকারের উচিত অতি আশাবাদী প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা থেকে সরে এসে অর্থনীতির বিদ্যমান পরিস্থিতির ভিত্তিতে পরিকল্পনা করা। তাঁর মতে, বরাদ্দের অঙ্কে চোখের শান্তি মেলে, কিন্তু বাস্তবায়নযোগ্য বাজেটই দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
আগামী বাজেটে সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, যা সংশোধন করে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামানো হয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এডিবি মনে করছে, বাংলাদেশ ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতেও হিমশিম খাবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি জটিল সন্ধিক্ষণে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এবং বিনিয়োগের নিম্নমুখী প্রবণতা কাটিয়ে উঠতে হলে একটি বাস্তবমুখী বাজেট প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি। অংশীজনদের মতামত গ্রহণ করে একটি সুসংহত ও টেকসই বাজেট প্রণয়ন করতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। সরকার যদি লক্ষ্যভিত্তিক এবং বাস্তবমুখী পরিকল্পনা নেয়, তবে দীর্ঘমেয়াদে জনগণ এর সুফল পাবে।