বর্তমানে বাংলাদেশ একটি ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যার নাম চিকুনগুনিয়া। এক সময় শুধু আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে সীমাবদ্ধ এই ভাইরাস আজ বিশ্বের বহু দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। ঘরে ঘরে মানুষ জ্বরে ভুগছে, অনেকেই হাঁটাচলা করতে পারছে না, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ভুগছে শরীরের গিঁট ও পেশির তীব্র ব্যথায়। অনেকে আবার বছরের পর বছর ধরে এর কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছেন।
ডেঙ্গুর মতোই এটি একটি মশাবাহিত ভাইরাস। তবে এর প্রকৃতি এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব একে আরও মারাত্মক করে তুলেছে। এই কলামে আমরা জানব চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ, প্রভাব, চিকিৎসা, প্রতিরোধ ও আমাদের সামনে আসন্ন স্বাস্থ্য বিপদের চিত্র।
চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসঘটিত সংক্রামক রোগ, যা এডিস এজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৫৩ সালে তানজানিয়ার একটি জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে। ভারতে প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৬৩ সালে এবং বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য প্রাদুর্ভাব শুরু হয় ২০১৭ সাল থেকে। তবে ২০২৫ সালে এসে এই রোগ যেন আবার ফিরে এসেছে আরও ভয়ংকর রূপে।
চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যার প্রাথমিক লক্ষণগুলো অনেকটাই ডেঙ্গু জ্বরের মতো হওয়ায় অনেক সময় রোগটি নির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। সাধারণত সংক্রমণের পর ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়—এই সময়টিকে ইনকিউবেশন পিরিয়ড বলা হয়। এই ধাপে রোগী সাধারণত হঠাৎ করে উচ্চমাত্রার জ্বরে আক্রান্ত হন, যা ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে। সঙ্গে দেখা দিতে পারে মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা, মাথা ঘোরা, পেশি ও গিঁটে ব্যথা, বমিভাব অথবা বমি, ত্বকে ফুসকুড়ি এবং প্রচণ্ড ক্লান্তি।
তবে চিকুনগুনিয়ার প্রকৃত ভয়াবহতা শুরু হয় জ্বর সেরে যাওয়ার পর। শরীর থেকে জ্বর চলে গেলেও অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে গিঁটে ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। এতটাই যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা হয় যে অনেক রোগী হাঁটাচলা করতে পারেন না, সিঁড়ি উঠতে পারেন না, এমনকি স্বাভাবিকভাবে বসার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেন। এই ব্যথা দিনের পর দিন চলতে পারে, এমনকি মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর স্থায়ী হয়ে যেতে পারে। এই দীর্ঘস্থায়ী গিঁটে ব্যথাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে “Post-viral chronic arthritis” বা “long chikungunya arthritis” নামে অভিহিত করা হয়।
এই রোগের আরেকটি চিন্তার বিষয় হলো এর জটিলতা। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে চিকুনগুনিয়া স্নায়বিক সমস্যা, চোখের দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হওয়া কিংবা রক্তে লিম্ফোসাইটের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পাওয়ার মতো দীর্ঘস্থায়ী লক্ষণ তৈরি করে। এসব উপসর্গ রোগীর জীবনমানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং কখনো কখনো অন্য রোগের রূপে আত্মপ্রকাশ করে রোগ নির্ণয়কে জটিল করে তোলে।
চিকুনগুনিয়ার এই ভয়ঙ্কর ধাপগুলো কেবল একটি ভাইরাসের সংক্রমণ নয়—এটি একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যাহত করতে পারে। ফলে, সময়মতো রোগ শনাক্ত ও যথাযথ চিকিৎসার পাশাপাশি এই রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
২০২৫ সালের বর্ষা মৌসুমে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজসহ দেশের বহু হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীর ভিড় বেড়ে গেছে। জ্বর, দুর্বলতা ও গিঁটে ব্যথা নিয়ে আসছেন ছোট শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও।
চিকিৎসকদের মতে, এখন প্রতিদিন শত শত রোগী আসছেন এই উপসর্গ নিয়ে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে অনেকের শরীরে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শনাক্ত হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এখনো সরকারি পর্যায়ে অধিকাংশ হাসপাতালে চিকুনগুনিয়ার টেস্ট করা যাচ্ছে না — করতে হচ্ছে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।
চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়া রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মশার প্রজনন এবং লার্ভার ঘনত্ব বেড়েছে বলে সতর্ক করেছে আইইডিসিআর।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া—দুই রোগই এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায় এবং উপসর্গের শুরু প্রায় একই রকম হলেও তাদের মধ্যে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ডেঙ্গুর কারণ ফ্ল্যাভি ভাইরাস, আর চিকুনগুনিয়া হয় আলফা ভাইরাস দ্বারা। উভয় ভাইরাসই মানুষের শরীরে প্রবেশ করে হঠাৎ উচ্চমাত্রার জ্বর সৃষ্টি করে, তবে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে গিঁটের ব্যথা তুলনামূলকভাবে কম এবং শরীরে প্লেটলেট কমে গিয়ে রক্তক্ষরণ ও মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে। অন্যদিকে, চিকুনগুনিয়ায় রক্তক্ষরণের আশঙ্কা খুব কম হলেও গিঁটের ব্যথা এতটাই তীব্র হয় যে তা মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর ধরে রোগীকে কষ্ট দিতে পারে।
জিকা ভাইরাস-ও ফ্ল্যাভি ভাইরাস গোত্রের, এবং এটি এডিস মশার মাধ্যমেই ছড়ায়। তবে জিকা ভাইরাস অনেক সময় খুব সামান্য বা মৃদু উপসর্গ সৃষ্টি করে, যেমন হালকা জ্বর, ত্বকে র্যাশ, চোখ লাল হওয়া, পেশি ও গিঁট ব্যথা ইত্যাদি। সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো—গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে জিকা ভাইরাস সন্তানের মস্তিষ্ক গঠনে প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে ‘মাইক্রোসেফালি’ নামক জন্মগত বিকলাঙ্গতা দেখা দিতে পারে। যদিও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত জিকার প্রকোপ ব্যাপক নয়, তবে দক্ষিণ আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশে এটি একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে, সাধারণ ভাইরাসজনিত জ্বর বা ভাইরাল ফিভার সাধারণত মৌসুমি বা জলবায়ু পরিবর্তনের সময় বেশি দেখা যায় এবং এর পেছনে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস দায়ী হতে পারে, যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। এই জ্বরের উপসর্গও প্রাথমিকভাবে হঠাৎ জ্বর, শরীর ব্যথা, গলা ব্যথা, হালকা কাশি এবং দুর্বলতা হতে পারে। তবে এর প্রকৃতি অনেকটাই মৃদু, এবং সাধারণত ৩-৫ দিনের মধ্যে বিশ্রাম ও প্রচুর তরল গ্রহণের মাধ্যমে সেরে যায়। তবে ভাইরাল জ্বরের লক্ষণ কোনো সময় গুরুতর রোগের আভাসও হতে পারে—তাই উপসর্গ অব্যাহত থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
এই চারটি রোগই প্রাথমিকভাবে জ্বর, ব্যথা, দুর্বলতা ইত্যাদির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে, যার ফলে প্রথম অবস্থায় আলাদা করে শনাক্ত করা কঠিন হয়। তবে প্রতিটির পেছনে আলাদা ভাইরাস ও ভিন্ন জটিলতা কাজ করে, যা চিকিৎসা ও প্রতিরোধ কৌশলে ভিন্নতা তৈরি করে। তাই সচেতনতা, সময়মতো পরীক্ষা এবং উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমেই এই রোগগুলোর প্রকোপ থেকে নিজেকে ও সমাজকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।
চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত অসুস্থতা হলেও এর প্রভাব শুধুমাত্র স্বাস্থ্যগত নয়; বরং এটি একটি গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের জন্ম দেয়, বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে। এই রোগের কারণে শরীরে প্রচণ্ড জ্বর, হাড়-জোড়ায় অসহ্য ব্যথা ও দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতা দেখা দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায়শই সপ্তাহখানেক পুরোপুরি অচল হয়ে পড়েন, অনেকে আবার মাসখানেক পরেও হাঁটাচলা বা কাজ করতে পারেন না। ফলস্বরূপ, যারা দৈনিক মজুরি নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন— যেমন রিকশাচালক, দিনমজুর, পোশাক শ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক কিংবা ভাসমান বিক্রেতা— তাদের জীবন তীব্র সংকটে পড়ে।
একজন দিনমজুর একদিন কাজ না করলে তার পরিবারের অন্নসংস্থান বন্ধ হয়ে যায়। সেই পরিবারের যদি ৪-৫ জন সদস্য একসাথে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়, তবে পুরো পরিবার আর্থিকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে অনেকেই সন্তানদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দেন, বা চিকিৎসার খরচ মেটাতে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন। অনেক পরিবার বাধ্য হয়ে স্থানীয় চক্রের উচ্চ সুদে ধার করে, যা পরে দারিদ্র্যের চক্র আরও গভীর করে তোলে।
এই ভাইরাসের প্রভাব শুধুমাত্র আয় হারিয়ে ফেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে চিকিৎসা ব্যয়, সময়ের অপচয়, কর্মঘণ্টার ক্ষতি এবং মানসিক হতাশা। চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়, আবার বেসরকারি ক্লিনিকে গেলে খরচ বহন করা সম্ভব হয় না। ফলে অনেকেই ঠিকভাবে চিকিৎসা না নিয়ে কষ্টে দিন কাটান, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে কর্মক্ষমতায়। এটি আবার দেশে সামগ্রিক উৎপাদনশীলতাও হ্রাস করে, বিশেষ করে শ্রমনির্ভর শিল্প ও খাতগুলোতে।
সামাজিকভাবে এই রোগ হতাশা, আতঙ্ক এবং একপ্রকার বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়। যারা আক্রান্ত হন, তাদের পরিবারের সদস্যরা কখনো কখনো সামাজিকভাবে আলাদা হয়ে পড়েন। আবার একাধিকবার সংক্রমণ হলে অনেকের মধ্যে মানসিক উদ্বেগ, কাজের প্রতি অনাগ্রহ ও দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্নতা তৈরি হয়। অন্যদিকে, কিছু এলাকায় ভুল ধারণার কারণে চিকুনগুনিয়া আক্রান্তদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণও পরিলক্ষিত হয়, যা সামাজিক সংহতিকে দুর্বল করে তোলে।
এই বাস্তবতা প্রমাণ করে যে, চিকুনগুনিয়া একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে, যার প্রতিকারে শুধু চিকিৎসা নয়, বরং সমন্বিত সামাজিক সহায়তা ও নিরাপত্তা নীতিমালা প্রয়োজন।
চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত সংক্রমণ হওয়ায় এর কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ বা টিকা এখনো বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারে আসেনি, যদিও কয়েকটি দেশে সম্ভাব্য টিকার ট্রায়াল চলছে। ফলে এই রোগের চিকিৎসা এখনো সম্পূর্ণভাবে উপসর্গভিত্তিক। অর্থাৎ, রোগীর শরীরে যেসব উপসর্গ প্রকাশ পায়, সেগুলোর উপশম করাই চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য।
রোগের শুরুতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, ফলে জ্বর নিয়ন্ত্রণ এবং বিশ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। জ্বরের সময় রোগীকে অবশ্যই পর্যাপ্ত বিশ্রামে রাখতে হবে। ঘুম ও বিশ্রাম শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শরীরকে প্রস্তুত করে। একইসঙ্গে শরীরে পানিশূন্যতা এড়াতে পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল খাবার গ্রহণ করা জরুরি। ডাবের পানি, লবণ-চিনিযুক্ত ওর্যাল স্যালাইন, লেবু পানি, স্যুপ ইত্যাদি তরলজাত খাবার রোগীকে বারবার সেবন করানো উচিত।
ব্যথা এবং জ্বর উপশমে প্যারাসিটামল অথবা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে যদি রোগীর প্লেটলেট সংখ্যা কমে যায়, তবে ওষুধের প্রতি বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। প্লেটলেটের মাত্রা হ্রাস পেলে আইবুপ্রোফেন বা অনুরূপ ওষুধ রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্যারাসিটামলই নিরাপদ বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন সি এবং ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। টক জাতীয় ফল যেমন মাল্টা, কমলা, লেবু এবং ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাবার যেমন সামুদ্রিক মাছ, তিসি বীজ ও বাদাম জাতীয় খাদ্য উপকারী হতে পারে। পাশাপাশি আদা চা ও তুলসি পাতার রসের মতো প্রাকৃতিক উপশমদায়ক উপাদানও অনেক রোগীর জন্য আরামদায়ক হিসেবে কাজ করে। আদা ও তুলসিতে আছে প্রদাহনাশক ও রোগপ্রতিরোধক উপাদান, যা জয়েন্টের ব্যথা এবং দেহের জড়তা কমাতে সহায়তা করে।
তবে কিছু ওষুধ ও অভ্যাস রয়েছে, যা এ সময় এড়িয়ে চলা অত্যন্ত জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাসপিরিন বা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ কোনো অবস্থাতেই গ্রহণ করা উচিত নয়, কারণ এগুলো রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। একইভাবে, অনেকেই ভুলভাবে নিজে নিজেই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন শুরু করেন, যা ভাইরাসজনিত রোগে কোনো উপকারে আসে না এবং বরং ভবিষ্যতের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত অবস্থায় শরীরচর্চা বা ভারী কোনো শারীরিক পরিশ্রম একেবারে নিষেধ। বিশেষ করে জয়েন্টের ব্যথা থাকলে এই ধরনের কাজ শরীরের অবস্থা আরও খারাপ করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি জয়েন্ট সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই পূর্ণরূপে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যথাসম্ভব বিশ্রামে থাকার চেষ্টা করতে হবে।
সার্বিকভাবে, চিকুনগুনিয়া থেকে সেরে উঠতে ধৈর্য, সঠিক উপশম ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই রোগকে অবহেলা না করে সংক্রমণের পরপরই সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে জটিলতা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।
চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসঘটিত রোগ হলেও এর বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর টিকা বা নির্দিষ্ট ওষুধ এখনো বাজারে আসেনি। ফলে এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো প্রতিরোধ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ইতোমধ্যে সতর্ক করে জানিয়েছে যে, যদি এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে এটি দ্রুত একটি বিশ্বব্যাপী মহামারীতে রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আক্রান্ত এলাকাগুলোতে রোগটির বিস্তার আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
চিকুনগুনিয়া ছড়ায় এডিস প্রজাতির মশার কামড়ের মাধ্যমে। এই মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায় এবং জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে প্রজনন করে। তাই প্রথম ও প্রধান কাজ হলো— জমে থাকা পানির উৎস নির্মূল করা। বাসাবাড়ির ফুলের টব, ফ্রিজের নিচের ট্রে, পরিত্যক্ত টায়ার, টিনের কৌটা কিংবা যে কোনো খোলা পাত্রে যদি তিনদিনের বেশি পানি জমে থাকে, সেটিই মশার জন্মের আদর্শ স্থান হয়ে ওঠে। এসব স্থান নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে এবং পানির জমাটবদ্ধতা রোধে সক্রিয় হতে হবে।
মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে প্রতি ঘণ্টায় মশারি ব্যবহার করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, বিশেষ করে দিনের বেলায় শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য। বাসা-বাড়ির জানালায় মশানিরোধী জাল লাগানো মশার প্রবেশ রোধে কার্যকর একটি উপায়। এছাড়াও মশার কামড় থেকে ত্বক রক্ষায় মশা প্রতিরোধক স্প্রে বা লোশন ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়। বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার আগে কিংবা ঘরের বাইরে কাজ করতে হলে শরীরের খোলা অংশে এই প্রতিরোধক প্রয়োগ করা জরুরি।
অবশ্যই শুধুমাত্র মশা দমন করলেই হবে না, সাথে সাথে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলতে হবে। করোনাকালের শিক্ষা আমাদের দেখিয়েছে— মাস্ক ব্যবহার, নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস এবং ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা শুধু ভাইরাসজনিত রোগ নয়, বরং মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধেও সহায়ক।
এতসব প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য দরকার সচেতনতা। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও), স্থানীয় সরকার এবং নাগরিক সমাজকে একত্রে কাজ করতে হবে। স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির বা কমিউনিটি সেন্টারে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো যেতে পারে। গণমাধ্যমে সংবাদ, টকশো এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রচার বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষ দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাবে।
চিকুনগুনিয়া মোকাবিলায় ব্যক্তি, পরিবার এবং রাষ্ট্র—সবার একসঙ্গে কাজ করাটাই একমাত্র উপায়। সময় থাকতে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ না নিলে এই রোগ কেবল শারীরিক নয়, অর্থনৈতিকভাবেও বড় ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়া একটি প্রতিনিয়ত ফিরে আসা জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এই ভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অথচ এত বছর পরেও এখনো এই ভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর কোনও সরকারি কৌশল বা পর্যবেক্ষণমূলক (মনিটরিং) ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। প্রতিটি মৌসুমে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে, আর তখনই কিছুদিনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়— যা দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধান দিতে পারে না। তাই এখনই সময়, যখন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে এবং এটি করতে হবে দ্রুততার সাথে।
প্রথমেই দরকার একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ। চিকুনগুনিয়ার মতো ভাইরাসবাহিত রোগকে ঠেকাতে হলে একদিন বা একমাসের অস্থায়ী কার্যক্রমে চলবে না। প্রয়োজন একটি সুস্পষ্ট দীর্ঘমেয়াদি কৌশল— যেখানে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় সরকার, নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবিদদের সম্পৃক্ত করে জাতীয় স্তরে একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। এই পরিকল্পনায় রোগের বিস্তার, রোগতত্ত্বীয় (epidemiological) পর্যালোচনা, প্রতিরোধমূলক অবকাঠামো, এবং শিক্ষামূলক কর্মসূচি সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত, জেলা ও উপজেলা ভিত্তিক ‘র্যাপিড রেসপন্স টিম’ (Rapid Response Team) গঠন করতে হবে। এসব দল স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত এলাকায় পৌঁছে দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ, চিকিৎসা, সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। তারা হাসপাতাল, ওয়ার্ড, স্কুল, বাজার ও বাসাবাড়িতে ক্যাম্পের মাধ্যমে দ্রুত কাজ করবে। এই ধরণের কাঠামো ইতোমধ্যেই কিছু উন্নত ও মধ্যম আয়ের দেশে সফলভাবে কাজ করছে, যা বাংলাদেশেও অনুসরণযোগ্য।
তৃতীয়ত, মহানগর ও পৌরসভাগুলোর মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী ও নিয়মিত করতে হবে। ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে মাঝে মাঝে কিছুদিনের ফগিং কার্যক্রম চালানো হয়, কিন্তু তা অনেক সময় অসংলগ্ন ও অপর্যাপ্ত হয়। ফগিংয়ের পাশাপাশি প্রয়োজন দরজায় দরজায় সচেতনতা প্রচার, লিফলেট বিতরণ, বিলবোর্ডে সতর্কতামূলক বার্তা এবং স্কুল ও ওয়ার্ডভিত্তিক তথ্য সেশন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সরাসরি সম্পৃক্ত করলেই এর প্রভাব বহুগুণ বাড়বে।
চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধি অপরিহার্য। আজও অনেক সরকারি হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার কিট থাকে না। রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীদের বেসরকারি ল্যাবের উপর নির্ভর করতে হয়, যা নিম্নআয়ের মানুষের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। সরকারকে হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত টেস্ট কিট সরবরাহ, মশাবাহিত রোগ সম্পর্কে প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ, এবং চিকিৎসক ও নার্সদের প্রয়োজনীয় গাইডলাইন প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
অতএব, চিকুনগুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য কেবল ব্যক্তি সচেতনতা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা ও কাঠামোগত পদক্ষেপ নেওয়াই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। না হলে প্রতিবছর এই রোগ মানুষের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকেও বিপর্যস্ত করে তুলবে।
চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত রোগ হলেও এখনো পর্যন্ত এটির কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষেধক বা টিকা উদ্ভাবিত হয়নি। তাই রোগটির প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনার জন্য গবেষণা ও উদ্ভাবনের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এই রোগের প্রকোপ বাড়ছে, অথচ স্থানীয় পর্যায়ে এ নিয়ে গবেষণার পরিধি এখনো সীমিত। ভাইরাসটির জেনেটিক পরিবর্তন, সংক্রমণ চক্র, বাহক মশার আচরণ, মৌসুমি প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ— এসব বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের বিস্তার, লক্ষণ, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং রোগ-পরবর্তী জটিলতা নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা চালানো দরকার। স্থানীয় চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা, রোগীদের উপসর্গ, প্রতিক্রিয়া ও পুনরুদ্ধার সময় বিশ্লেষণ করে একটি উপযুক্ত চিকিৎসা প্রটোকল প্রণয়ন করা যেতে পারে, যা ভবিষ্যতের জন্য কার্যকর রূপরেখা হিসেবে কাজ করবে।
এ ছাড়া, স্বল্পমূল্যের পরীক্ষার কিট ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্রতিরোধী ওষুধ বা উপশমমূলক থেরাপি উদ্ভাবন করাও অত্যন্ত জরুরি। প্রযুক্তি ব্যবহার করে মশার প্রজনন অঞ্চল শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণে স্মার্ট অ্যাপ বা সেন্সরভিত্তিক নজরদারি ব্যবস্থা তৈরি করা যেতে পারে। স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বায়োটেক স্টার্টআপগুলোকে উৎসাহিত করে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে উদ্ভাবনী গবেষণা ত্বরান্বিত করা সম্ভব।
তথ্যভিত্তিক গবেষণার পাশাপাশি সামাজিক গবেষণাও গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে জনগণের আচরণ, স্বাস্থ্যসচেতনতা, এবং স্থানীয় বিশ্বাস বা কুসংস্কার নিয়ে। কারণ প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ডের সফলতা অনেকাংশেই নির্ভর করে জনগণের মনোভাব ও অংশগ্রহণের ওপর।
সব মিলিয়ে বলা যায়, চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে টেকসই সমাধান পেতে হলে গবেষণা ও উদ্ভাবনকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থাগুলোকেও এই মিশনে সম্পৃক্ত করা জরুরি।
চিকুনগুনিয়ার মতো জনস্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি সচেতন অংশের অংশগ্রহণ একান্ত জরুরি। এই প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম এবং সাধারণ নাগরিকরা হয়ে উঠতে পারেন সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধের প্রথম সারির যোদ্ধা। গণমাধ্যমের শক্তিশালী ভূমিকা কেবল সংবাদ পরিবেশনে সীমাবদ্ধ নয়— এটি জনসচেতনতা গড়ে তুলতে, সঠিক তথ্য ছড়াতে এবং গুজব দমন করতে এক অনন্য হাতিয়ার।
টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র, অনলাইন মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর উচিত নিয়মিতভাবে চিকুনগুনিয়া সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রচার করা, ভাইরাসের লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসার পদ্ধতি সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা। বিশেষজ্ঞদের মতামত, রোগীদের অভিজ্ঞতা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রচেষ্টা তুলে ধরে এই রোগের বিরুদ্ধে একটি সামাজিক প্রতিরোধ কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব। পাশাপাশি ভুয়া চিকিৎসা পরামর্শ কিংবা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারে বিরত থাকা এবং সেই ধরনের প্রচারণার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াও গণমাধ্যমের নৈতিক দায়িত্ব।
অন্যদিকে, প্রতিটি নাগরিকের উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করা। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা, জমে থাকা পানি অপসারণ, মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করা— এসব ছোট ছোট অভ্যাসই পারে বড় বিপর্যয় ঠেকাতে। মশারী ব্যবহার, জানালায় নেট লাগানো, স্প্রে বা ক্রিম ব্যবহার— এগুলোকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।
এছাড়া নাগরিকদের উচিত স্থানীয় প্রশাসন বা পৌর কর্তৃপক্ষকে সচেতন করা, মশার উপদ্রবের বিষয়ে জানানো এবং প্রতিকার দাবিতে সক্রিয় হওয়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যুব সমাজ ও পাড়াভিত্তিক সংগঠনগুলো যদি সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালায়, তবে মানুষের মনোজগতে এ রোগ সম্পর্কে দীর্ঘস্থায়ী সচেতনতা তৈরি হবে।
সবশেষে, এটা মনে রাখা দরকার— চিকুনগুনিয়া শুধু একটি ভাইরাস নয়, এটি আমাদের জীবনযাপনের পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কেবল সরকারের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। নাগরিক সচেতনতা ও গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা একত্রে গড়ে তুলতে পারে একটি কার্যকর প্রতিরোধ বলয়। আমরা যদি সবাই এগিয়ে আসি, সচেতন হই এবং দায়িত্ব পালন করি, তবে এই মরণব্যাধিকেও রুখে দেওয়া সম্ভব।
চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাস মাত্র নয়—এটি আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, নাগরিক সচেতনতা এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের এক কঠিন পরীক্ষার নাম। কয়েকদিনের জ্বর, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা কিংবা দুর্বলতা দিয়ে শুরু হওয়া এই রোগ আমাদের সমাজে রেখে যাচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত। এটি শুধু একজন রোগীকে নয়, তার পরিবারকে, পাড়াকে, এমনকি পুরো কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকেই পঙ্গু করে দিচ্ছে সাময়িকভাবে। আর এই সাময়িক অক্ষমতাই একেকটি পরিবারকে ঠেলে দিচ্ছে দারিদ্র্যের গভীরে।
এই পরিস্থিতিতে, ভিন্ন ভিন্ন পক্ষকে আর আলাদা করে ভাবার সময় নেই। সরকার, নাগরিক সমাজ, স্বাস্থ্যকর্মী, গণমাধ্যম, স্থানীয় প্রশাসন—সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দরকার একটাই—সাংগঠনিক প্রস্তুতি, বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা, এবং সর্বোপরি মানুষকে সচেতন করে তোলার আন্তরিক প্রচেষ্টা। আমরা যদি এখনই উদ্যোগ না নিই, তাহলে একদিন এই ভাইরাস শহর ছাড়িয়ে গ্রাম, জেলা ছাড়িয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সঙ্কটে রূপ নিতে পারে।
প্রতিরোধই যেখানে একমাত্র উপায়, সেখানে গাফিলতির কোনো স্থান নেই। ‘চিকুনগুনিয়া’ নামটি যেন আর কোনো শিশুর কান্না না ডাকে, যেন কোনো শ্রমজীবী বাবা ছেলের ওষুধ কিনে দিতে না পারার যন্ত্রণায় ভেঙে না পড়ে—সেই দায়িত্ব আজ আমাদের সকলের।
এখনও সময় আছে। আমরা যদি চাই, সচেতন হই, দায়িত্ব নিই—তবে এই বিপদ রুখে দেওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ পারে, যদি বাংলাদেশ চায়।
তাজুল ইসলাম, কবি, লেখক ও গবেষক