বাংলাদেশে গুম ও ভয়াবহ নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অভিযোগ এবার স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে একটি তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: এ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’-এ। সেখানে ২৫৩ জন গুম হওয়া ব্যক্তির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, কেউ ৩৯ দিন, কেউবা ৩৯১ দিন পর্যন্ত বন্দি ছিলেন গোপন টর্চার সেলে। কারও হাত-পা বেঁধে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছে, আবার কাউকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রে নির্যাতন ছিল আরও বেশি অপমানজনক—ওড়না খুলে রাখা, জানালার সামনে ঝুলিয়ে রাখা, এমনকি পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন চাওয়া নিয়ে কটূক্তি করাও ছিল এই নির্যাতনের অংশ।
প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে র্যাব-২, র্যাব-১০, সিপিসি-৩, এবং সিটিটিসি-র ভূমিকাকে। অভিযোগ রয়েছে, এসব বাহিনীর নির্দিষ্ট ইউনিটগুলো সাউন্ডপ্রুফ রুম, ঘূর্ণায়মান চেয়ার, পুলি সিস্টেম ও ওয়াটারবোর্ডিংয়ের মতো পদ্ধতি ব্যবহার করে বন্দিদের ওপর দিনের পর দিন নির্যাতন চালিয়েছে।
শুধু ভুক্তভোগী নয়, তাদের পরিবারগুলোর জীবনও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ে। সামাজিকভাবে নিঃসঙ্গতা, অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস, সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়া—সব মিলিয়ে গুম কেবল একজন ব্যক্তির নয়, গোটা পরিবারের জীবন বদলে দিয়েছে।
প্রতিবেদনের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক অংশ নারীদের অভিজ্ঞতা। এক নারী জানান, তাকে ক্রুশের মতো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। জানালার পাশে ঝুলে থাকার সময় বাহিনীর সদস্যরা ব্যঙ্গ করে বলতো, ‘এমন পর্দা করছিল, এখন সব পর্দা খুলে গেছে।’ নারীরা অনেক সময় স্যানিটারি প্যাড চাইলে সেটাকেও হাসির বিষয় বানানো হতো।
শুধু নির্যাতন নয়, টর্চার সেলের অবস্থাও ছিল ভয়ঙ্কর। ঘরগুলো ছোট ও সিসিটিভি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত। টয়লেট ব্যবহার করতে হতো প্রকাশ্যে, শোয়ার জায়গায় পড়ে থাকতো ময়লা ও বর্জ্য। খাবার ছিল অনিরাপদ, ঘুমাতে দেওয়া হতো না, ঠান্ডায় কাঁপতে হতো কম্বল ছাড়া।
২০২৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর গঠিত গুম কমিশন বলেছে, বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ হতে পারে। তাদের মতে, এই প্রবণতা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে একটি পরিকল্পিত ব্যবস্থা হিসেবে রূপ নিয়েছে। সঠিক বিচার ও জবাবদিহিতা ছাড়া এই পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে গুম ও নির্যাতনের ঘটনা এখন আর গুজব নয়, বাস্তবতা। এই ভয়ঙ্কর মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, শক্তিশালী বিচারিক তদন্ত ও আন্তর্জাতিক নজরদারি প্রয়োজন।