বাউলের শিরোমণি ফকির লালন শাহের ১৩৫তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানকে ঘিরে বাউল-বাউলানি, ভক্ত-অনুরাগী ও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াস্থ লালন আখড়াবাড়ি। ভাব-জগতের মরমি গানের সুরে মেতে উঠেছেন শিল্পী, ভক্ত ও দর্শক-শ্রোতারা।
এ বছর প্রথমবারের মতো জাতীয় পর্যায়ে লালন তিরোধান দিবস পালন হওয়ায় উৎসবটি পেয়েছে নতুন মাত্রা। আখড়াবাড়ি ও মেলা প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে পড়েছে উৎসবের আমেজ। মরাকালিগঙ্গা নদীর পাড়ে লালনের স্মৃতিবিজড়িত মাজার এলাকাটি পরিণত হয়েছে এক মহামিলনমেলায়।
ফকির লালন শাহ ছিলেন মানবতাবাদী ও ভাব-জগতের সাধক। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে তাঁর মরমি গান মানবপ্রেম ও আত্মজ্ঞান চর্চার আহ্বান জানাচ্ছে। লালনের গানের মূল কথা — মানুষ ভজলে হবি সোনার মানুষ। তাঁর গানে প্রতিফলিত হয়েছে ভালোবাসা, সাম্য ও মানবতার অমলিন বার্তা।
শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেলে উদ্বোধনী দিনে অনলাইনে যুক্ত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা ফারুকী সরয়ার। বিশেষ অতিথি ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এবং সংস্কৃতি সচিব মো. মফিদুর রহমান।
মূল বক্তা ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, আর স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক রেজাউদ্দিন স্টালিন।
সভায় সভাপতিত্ব করেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফিন। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ফরহাদ মজহার ও অধ্যাপক আল মামুন। উদ্বোধনের আগে প্রদর্শিত হয় ফকির লালনের জীবন ও দর্শনভিত্তিক তথ্যচিত্র।
আলোচনা শেষে শুরু হয় মূল গানের অনুষ্ঠান। একের পর এক লালনের জনপ্রিয় গান — “মানুষ ভজলে হবি সোনার মানুষ”, “জাত গেল জাত গেল বলে”, “মিলন হবে কত দিনে”— পরিবেশনে ভরে ওঠে পরিবেশ। একতারা, দোতারা, ঢোলের সুরে হাজারো দর্শক হারিয়ে যান লালনের গানে।
আখড়ার চারপাশে বসেছে বাউল-সাধুদের খণ্ড খণ্ড গানের আসর, মাজার সংলগ্ন অডিটোরিয়ামে চলছে বাউল হাট। গ্রামীণ ঐতিহ্যে ভরা মেলায় বিক্রি হচ্ছে হাতে তৈরি বাদ্যযন্ত্র, পোশাক ও স্থানীয় খাবার।
সংস্কৃতি সচিব মফিদুর রহমান বলেন, “লালন ছিলেন মানুষের মুক্তি ও সত্যের সাধক। তাঁর দর্শন মানুষে মানুষে সমতা ও ভালোবাসার ভিত্তি স্থাপন করেছে।”
বিশেষ অতিথি ফরিদা আখতার বলেন, “লালনের দর্শন আজও আমাদের চিন্তায় প্রাণ সঞ্চার করে।”
লালন ভক্তরা জানান, ফকির লালন জীবদ্দশায় ভক্তদের নিয়ে সাধন-ভজন করতেন। সেই ঐতিহ্যেই প্রতিবছর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আধ্যাত্মিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
১৮৯০ সালের ১ কার্তিক (১৭ অক্টোবর) তিরোধানের পর তাঁকে তাঁর পালক মা মতিজান ফকিরানীর পাশে সমাহিত করা হয়। ১৯৬৩ সালে এই সমাধিস্থল ঘিরেই গড়ে ওঠে বর্তমান নয়নাভিরাম লালন মাজার কমপ্লেক্স।