সময়—একটি শব্দ, যার ভেতর লুকিয়ে আছে জাতির ভাগ্য নির্ধারণের অদৃশ্য ছন্দ। ঘড়ির কাঁটায় এর গতি মাপা যায় ঠিকই, কিন্তু এর তাৎপর্য ছাড়িয়ে যায় কালের সীমা। সময় একদিকে জীবনের শৃঙ্খল, অন্যদিকে পরিবর্তনের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। আজ বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে সময় শুধু দামী নয়—এটি সিদ্ধান্তের, সংস্কারের এবং স্বপ্ন পূরণের শ্রেষ্ঠ সুযোগ। গণতান্ত্রিক জাগরণ, সংবিধান পুনর্গঠন, কূটনৈতিক স্বকীয়তা ও অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতার এই সময়—কোনোভাবেই উপেক্ষা করার নয়। কারণ, সময় চলে গেলে ফিরে আসে না—আর এই সময়ই হতে পারে নতুন বাংলাদেশের পথরেখা।
হীরা মূল্যবান এক রত্ন। অর্থ দিয়ে কেনা যায়, আবার হারিয়ে গেলে কিছুটা চেষ্টা করে পুনরায় পাওয়া সম্ভব। কিন্তু সময়? একবার যে মুহূর্ত পেরিয়ে যায়, তা কখনও আর ফেরে না। সময় হারানো মানে জীবনের এক অপূরণীয় ক্ষতি। এ দিক থেকে সময়ের মূল্য হীরার ঊর্ধ্বে—অদৃশ্য হলেও সবচেয়ে বাস্তব, নীরব হলেও সবচেয়ে বলবান।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তঃদ্বন্দ্ব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, এবং বৈদেশিক প্রভাবের ছায়ায় জনগণের প্রকৃত কল্যাণ প্রায় উপেক্ষিত থেকেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি চিরকাল চলতে পারে না। এখনই সময়—সংবিধান, রাজনীতি এবং অর্থনীতির এক নতুন রূপান্তরের জন্য।
আজ প্রয়োজন একটি জনকল্যাণমুখী সংবিধান—যা কেবল ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করবে না, বরং জনগণের মৌলিক অধিকার, ন্যায়বিচার এবং অর্থনৈতিক সমতার সুরক্ষাকেও নিশ্চিত করবে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে এখনই ভ্রান্ত দলীয় স্বার্থের চক্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে। জনগণের দুঃখ, দুর্দশা, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব—এই বাস্তব সমস্যাগুলোকে সামনে রেখে কাজ করতে হবে।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হতে হবে স্বাধীন, ভারসাম্যপূর্ণ ও জাতীয় স্বার্থভিত্তিক। ভারতের ‘আশ্রয়’ বা ‘পৃষ্ঠপোষকতা’ থেকে বের হয়ে বাংলাদেশকে দাঁড়াতে হবে নিজস্ব অবস্থানে, যেখানে আমাদের সম্পর্ক হবে পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে, কোনো একতরফা নির্ভরতার নয়। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এখন বাংলাদেশ একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ দেশ, এবং আমাদের এই অবস্থানকে কাজে লাগাতে হবে দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে।
বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা একজন বিশ্ববরেণ্য ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ এখনই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও দৃঢ়ভাবে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে পারে। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, শ্রমবাজার—সবখানে বাংলাদেশের কণ্ঠস্বরকে আরও শক্তিশালীভাবে তুলে ধরার প্রয়োজন রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা পরিশ্রম, দক্ষতা ও সততার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছেন। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশি জনশক্তিকে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে আরও সংগঠিতভাবে রপ্তানি করার—শুধু মজুরির জন্য নয়, বরং মর্যাদা, নিরাপত্তা ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। প্রশিক্ষিত ও আধুনিক শ্রমশক্তি দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব শ্রমবাজারে নেতৃত্ব দিতে পারে, যদি আমরা সময়মতো প্রস্তুত হই।
বিশ্বজুড়ে সফল মানুষদের জীবন দেখলে দেখা যায়, সময়ের প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত সম্মানজনক। বিজ্ঞানী নিউটন, সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ, রাষ্ট্রনায়ক আব্দুল কালাম — সবাই সময়কে ব্যবহার করেছেন একনিষ্ঠতা, অধ্যবসায় ও লক্ষ্যনির্ধারিত প্রজ্ঞায়। তাঁদের সময় ব্যবহারের নেপথ্যেই আজ তাঁরা ইতিহাসের পাতায় অমর।
সময়ের সদ্ব্যবহার মানেই সময়কে বিনিয়োগ করা—শিক্ষা, দক্ষতা অর্জন, সম্পর্ক রক্ষা, কিংবা মানবিকতার চর্চায়। অন্যদিকে সময়ের অপচয় আমাদের ঠেলে দেয় অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে।
ছাত্রজীবন হলো জীবনের ভিত্তি গড়ার সময়। যারা এ সময়টাকে সঠিকভাবে কাজে লাগায়, ভবিষ্যতে তারাই তৈরি করে সফলতার গল্প। যারা অলসতায় বা বিলম্বে সময় নষ্ট করে, তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায়। তাই ছাত্রদের উচিত সময়কে বন্ধু বানানো, শৃঙ্খলা মেনে চলা, এবং প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো।
কর্মজীবনে যারা সময়মতো সিদ্ধান্ত নেয়, যারা সময়কে মূল্য দেয়, তারাই পদে পদে এগিয়ে যায়। যারা সময়ের অপচয় করে, তাদের উন্নতি থেমে যায়। সময় ব্যবস্থাপনা শুধু অফিসের কাজ নয়—এটি পরিবার, বন্ধুত্ব ও সমাজের সম্পর্কেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সময় না দিলে ভালোবাসা শুকিয়ে যায়, সম্পর্ক ফাঁকা হয়ে পড়ে।
একটি জাতির ইতিহাসে কিছু সময় আসে, যা কেবল ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখ হয়ে থাকে না—তা হয়ে ওঠে যুগান্তকারী এক সুযোগ। বর্তমান বাংলাদেশ এমনই এক সময় অতিক্রম করছে, যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অসন্তোষ, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং গণতান্ত্রিক প্রশ্নগুলো সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
মানুষের মধ্যে এখন পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। তরুণ সমাজ, নাগরিক বুদ্ধিজীবী মহল, মিডিয়া এবং সাধারণ জনগণ—সবাই যেন একটি উত্তরণের খোঁজে আছে। প্রশ্ন উঠছে—এই দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অসাম্য, দলীয় প্রভাব, এবং জবাবদিহিহীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন কি সম্ভব?
এখানেই "সময় হিরার চেয়েও দামী" কথাটির বাস্তব প্রাসঙ্গিকতা সামনে আসে। এখনই সেই সময়, যখন ব্যক্তি হিসেবে নয়—সমষ্টিগতভাবে সময়কে বিনিয়োগ করতে হবে সঠিক সিদ্ধান্ত, সচেতন অংশগ্রহণ, এবং গণতন্ত্র রক্ষার জন্য।
সময়ের অপব্যবহার যেমন একজন ব্যক্তিকে ধ্বংস করে, তেমনি সময়মতো রাজনৈতিকভাবে সজাগ না হলে একটি জাতিও পিছিয়ে পড়ে। যে জনগণ নিরব থাকে, ভোটাধিকার প্রয়োগে অনাগ্রহী থাকে, ন্যায়-অন্যায় নিয়ে প্রশ্ন তোলে না, তাদের ভবিষ্যত হয় অন্যের ইচ্ছার খেলনায় পরিণত।
বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের উচিত, সচেতনভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা, সত্য ও তথ্যভিত্তিক সংবাদ অনুসরণ করা, মত প্রকাশে সাহস দেখানো, গণতন্ত্র, সুশাসন ও জবাবদিহির পক্ষে অবস্থান নেওয়া, এই মুহূর্তেই সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আমরা হয়ে যাব দায়িত্বহীন।
গণতান্ত্রিক সংস্কার
গণতন্ত্র কেবল একটি ভোটের প্রক্রিয়া নয়—এটি হলো ন্যায়বিচার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জবাবদিহি ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি জীবনব্যবস্থা।
গণতান্ত্রিক সংস্কার বলতে বোঝায়—সেই কাঠামোগত, নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন যা:
নির্বাচনী ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করে
বিরোধী দলের মত প্রকাশ ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে
আইনের শাসনকে নিরপেক্ষভাবে কার্যকর করে
প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখে
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ: এখানে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, সংসদের কার্যকারিতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। গণতন্ত্রের প্রাণ হলো অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত, কিন্তু বাস্তবে জনগণের কথা শোনা হয় না। তাই এখনই সময়—রাজনৈতিক সংস্কার, পার্লামেন্টারি স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার।
সংবিধান পুনর্গঠন
বাংলাদেশের সংবিধান স্বাধীনতার পর সময় ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে একাধিকবার সংশোধিত হয়েছে, যার অনেকটাই দলীয় স্বার্থে। আজ সময় এসেছে সংবিধানকে জনকল্যাণমুখী ও সময়োপযোগী করার।
এক্ষেত্রে করণীয় হতে পারে:
বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা
নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা সংরক্ষণ
মৌলিক অধিকার রক্ষা এবং নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা
রাজনৈতিক দলগুলোর আর্থিক ও কার্যকর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা
দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেওয়া
সংবিধানকে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে গড়ে তুললে সেটি হয়ে উঠবে গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ।
কূটনৈতিক স্বকীয়তা
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। কিন্তু বহু সময় ধরে পররাষ্ট্রনীতি কোনো একটি দেশের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট থেকে গেছে।
কূটনৈতিক স্বকীয়তা বলতে বোঝায়:
জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সকল দেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা
দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপ রোধ করা
ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, আরব দেশসহ সকলের সঙ্গে নিজস্ব অবস্থান ও সম্মান বজায় রেখে বন্ধুত্ব রক্ষা
আজ দরকার এমন কূটনীতি যা বাংলাদেশের পানি, সীমান্ত, শ্রমবাজার, নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে, অন্য দেশের দৃষ্টিকোণ নয়।
অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতা
একটি দেশের স্বাধীনতা কেবল রাজনৈতিক নয়—অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভর হওয়াও তার মূল ভিত্তি। বহুজাতিক ঋণনির্ভরতা, আমদানিনির্ভর বাজার, ও বৈদেশিক দাননির্ভর উন্নয়ন আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতা মানে:
কৃষি ও শিল্প খাতকে ঘুরে দাঁড় করানো
দেশীয় উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসাকে সহায়তা করা
প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়ানো
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী নীতি প্রয়োগ
আমদানির তুলনায় রপ্তানিকে বাড়ানো
দেশের যুবসমাজ, নারী, ও মাইক্রো উদ্যোক্তারা হলে পারে এ আত্মনির্ভরতার চালিকাশক্তি।
জনগণের বাস্তব অংশগ্রহণ
গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয়, যখন জনগণের কণ্ঠস্বর নীতিনির্ধারণে প্রতিফলিত হয়। আজ অধিকাংশ সাধারণ মানুষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন—নির্বাচনে ভোট দিলেও তাদের চাহিদা, দুঃখ-কষ্ট কেউ শোনে না।
বাস্তব অংশগ্রহণ মানে:
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা
জনগণের প্রশ্ন তোলা ও জবাব পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা
বাজেট প্রণয়ন ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা
সচেতন নাগরিক সমাজ ও মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ দেওয়া
ইতিহাস কখনো অপেক্ষা করে না—ঠিক যেমন সময়ও কারো জন্য থেমে থাকে না। যে জাতি সময়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে, সেই জাতিই আগামীর পৃথিবীতে নিজের জায়গা করে নেয়। আর যে জাতি দোলাচলে পড়ে, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, তারা ইতিহাসের পাতায় বিস্মৃত হয়ে যায়।
আজ বাংলাদেশের সামনে এক বিরল সুযোগ—সংবিধান পুনর্গঠনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ভিত্তি মজবুত করা, বৈশ্বিক কূটনীতিতে শক্ত অবস্থান নেওয়া, অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভর হয়ে উঠা, আর সর্বোপরি জনগণকে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়ার প্রকৃত অংশীদার বানানো। এই মুহূর্তে প্রয়োজন সাহসী নেতৃত্ব, সময়োপযোগী সংস্কার, এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
আমরা যদি এখনই এগিয়ে আসি—ভবিষ্যৎ আমাদের অপেক্ষায় থাকবে। আর যদি পিছিয়ে পড়ি, সময় আমাদের পেছনে ফেলে যাবে।
এই সময় শুধু সুযোগ নয়, এটি দায়িত্ব। এখনই সময়—নতুন বাংলাদেশ গড়ার।
তিয়াসা জাহান নীলা,
শিক্ষক, গবেষক ও লেখক