২০২৫ শিক্ষাবর্ষে সরকারি বিনামূল্যে বিতরণ করা পাঠ্যবই নিয়ে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর তথ্যানুসারে, কিছু অসাধু ছাপাখানা মান যাচাইকারী ইন্সপেকশন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে মিলে নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই ছাপিয়ে সরকারের প্রায় ৩৫৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। ইতোমধ্যে ১৭টি ছাপাখানাকে চিহ্নিত করে তাদের কাছে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিল আটকে দেওয়া ও কালো তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এ বছর সারা দেশে প্রায় ৪০ কোটিরও বেশি বই বিতরণ করা হয়েছে। তবে টেন্ডারের নির্ধারিত শর্ত অনুযায়ী বই ছাপা হয়নি এমন অভিযোগে সরকার দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযান চালায়। এনসিটিবির নেতৃত্বে দুটি পরিদর্শন সংস্থা এবং দুটি গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত ৩২টি দল দেশের ৬৪ জেলা থেকে বইয়ের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করে। পরীক্ষায় দেখা যায়, প্রায় ৮ কোটিরও বেশি বই নিম্নমানের কাগজে ছাপা হয়েছে। কাগজের পুরুত্ব (GSM), উজ্জ্বলতা (Brightness) এবং টেকসই ক্ষমতা (Bursting Factor) — তিনটি প্রধান মানদণ্ডই অনেক ক্ষেত্রে মানা হয়নি।
বই ছাপার আগে ও পরে মান যাচাইয়ের দায়িত্বে থাকে ‘তৃতীয় পক্ষের’ ইন্সপেকশন এজেন্সিগুলো। প্রাথমিক স্তরের বইয়ে পিডিআই (Pre-Distribution Inspection) ও পিএলআই (Post-Logistics Inspection) একই কোম্পানি করে, আর মাধ্যমিক স্তরে দুটি কোম্পানি আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে। অভিযোগ রয়েছে, এই ইন্সপেকশন কোম্পানিগুলো ছাপাখানার মালিকদের কাছ থেকে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে বইয়ের গুণগত মান সম্পর্কে সবসময় পজিটিভ রিপোর্ট দেয়। ফলে ন্যূনতম মান রক্ষা ছাড়াই বই ছাপিয়ে দেওয়া হয়।
ইন্সপেকশন কোম্পানিগুলোর তদারকির সক্ষমতা নিয়েও রয়েছে গুরুতর প্রশ্ন। দেশে বর্তমানে ১১৫টি ছাপাখানার কাজ পর্যবেক্ষণের জন্য প্রতিটি ইন্সপেকশন কোম্পানির জনবল রয়েছে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ জন, যারা অধিকাংশই অদক্ষ এবং কম বেতনে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী। এমনকি ইন্সপেক্টরদের থাকার খাওয়া ও অন্যান্য খরচও ছাপাখানা মালিকদেরই বহন করতে হয়। এতে নিরপেক্ষতা বিঘ্নিত হয় এবং দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়।
২০২৫ শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের পিডিআই এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে ‘ব্যুরো ভ্যারিটাস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান, যারা মাত্র ৩২ লাখ টাকায় কাজটি পেয়েছে। এটি গত ১০ বছরে সর্বনিম্ন দর। অন্যদিকে প্রাথমিক স্তরের বইয়ের পিডিআই ও পিএলআই কাজ করেছে ‘ফিনিক্স’। এছাড়া বই ছাপার পর মান যাচাইয়ের জন্য মাঠপর্যায়ে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠানোর দায়িত্ব ছিল ‘হাইটেক সার্ভে বিডি’র, যাদের তদন্তেই ১৭টি ছাপাখানা অনিয়মে জড়িত হিসেবে ধরা পড়ে।
বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের বইয়ে অনিয়ম বেশি হয়েছে। এই বইগুলোর কাগজের পুরুত্ব, উজ্জ্বলতা ও বার্স্টিং ফ্যাক্টর—তিনটিই মানা হয়নি। ছাপাখানাগুলো কৌশলে জেলা সদর ও উপজেলা শহর বাদ দিয়ে মফস্বল এলাকায় এসব নিম্নমানের বই সরবরাহ করেছে। তাই এবার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে শুধুমাত্র মফস্বল অঞ্চল থেকে, যাতে এসব অনিয়ম পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলেন, তদারকি আরও কড়াকড়ি করা হলেও বাস্তবে অনিয়ম ঠেকানো যায়নি। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পাঠ্যবইয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। মুদ্রণ শিল্প সমিতির এক সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, এতসব সংস্থা ও তদারকির পরও নিম্নমানের বই বাজারে গেলে বোঝা যায়, “সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে”।
<
p data-start="3175" data-end="3372">বর্তমানে এনসিটিবি অনিয়মে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিল আটকে দিয়েছে এবং কালো তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে ইন্সপেকশন কোম্পানির মনোনয়নে আরও কঠোর মানদণ্ড আরোপের চিন্তাভাবনা চলছে।