২০২৪ সালের ৫ আগস্টের সকাল ছিল অজানা, অপ্রত্যাশিত ও নাটকীয়তায় ভরা। কেউই জানতেন না, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বড় পালাবদল ঘটতে চলেছে। আর দুপুর গড়াতেই আসে চাঞ্চল্যকর খবর—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং ভারতের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছেন।
সেদিনের আগের রাত, অর্থাৎ ৪ আগস্ট থেকেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয় জনতার ঢল। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের রেশ ধরে উত্তেজনায় টালমাটাল হয়ে ওঠে দেশ। পরিস্থিতির চূড়ান্ত মোড় নেয় ৫ আগস্ট দুপুরের দিকে।
ঘটনার গভীরে গিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উন্মোচন করেছেন। তিনি ২৫ মে (রবিবার) ট্রাইব্যুনালে একটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দাখিলের সময় এসব তথ্য উপস্থাপন করেন।
তাজুল ইসলামের ভাষ্যমতে, ৫ আগস্ট সকালে গণভবনে বসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। সেখানে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের পরামর্শ দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন— “তাহলে তোমরা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো, গণভবনে কবর দিয়ে দাও।”
তবে এই পরামর্শ শুধু সেনা কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকেই আসেনি। জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের কথা বলেন। যদিও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা, বিশেষ করে ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান খান এবং সালমান এফ রহমান—‘গ্যাং অব ফোর’ হিসেবে অভিহিত—তাকে কঠোর অবস্থান বজায় রাখার আহ্বান জানান।
৪ আগস্ট রাত ১২টার দিকে তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। সেখানে তারিক আহমেদ সিদ্দিক পদত্যাগের প্রস্তাব আনেন, কিন্তু শেখ হাসিনা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বরং সেনাপ্রধানকে নির্দেশ দেন, “মেরুদণ্ড শক্ত করে অবস্থান নিন, প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা নিন।”
তারিক সিদ্দিক এসময় হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর প্রস্তাব দেন, যাতে বিমানবাহিনীর প্রধান তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করেন এবং বলেন, “তারিক আপনাকে ডুবিয়েছে এবং আরও ডুবাবে।”
৫ আগস্ট সকালের এক বৈঠকে আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, “পুলিশ আর বেশিক্ষণ এই অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না।”
এই অবস্থায় সেনা কর্মকর্তারা শেখ রেহানার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। এমনকি রেহানা পা জড়িয়ে ধরেন, তবুও তিনি রাজি হননি। শেষপর্যন্ত পুত্র জয় ওয়াজেদের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে রাজি করানো হয়। জয় তার মাকে বোঝান, এ অবস্থায় পদত্যাগই নিরাপদ পথ। এরপর শেখ হাসিনা পদত্যাগে সম্মত হন এবং ভারতের উদ্দেশ্যে গমন করেন।
এই নাটকীয় মুহূর্তগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। অভ্যুত্থান, কূটনীতি, পরিবার ও রাজনীতির টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে একটি যুগান্তকারী রাজনৈতিক মোড় পরিবর্তনের সাক্ষী ছিল ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট।