বাংলাদেশ বর্তমানে বেশ কিছু বিতর্কিত ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বিশেষ আইন বাতিলের মাধ্যমে সরকারের চুক্তিগুলো বৈধতা পেলেও এটি প্রশ্ন তুলেছে পূর্বের দুর্নীতি ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি নিয়ে। আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনে হামলা এবং এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের তীব্র প্রতিবাদ কূটনৈতিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব ফেলেছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগকে সরকার অপপ্রচার বলে অভিহিত করলেও বিষয়টি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, যা দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বসুন্ধরা গ্রুপের সম্পদ জব্দ ও ব্যাংকিং খাতে সংকট দেখাচ্ছে যে, দেশের অর্থনৈতিক খাতের সুশাসন নিশ্চিত করতে আরও জবাবদিহিতা প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে চলমান বিতর্ক রাজনৈতিক আস্থা সংকট বাড়াচ্ছে। এই ঘটনাপ্রবাহগুলো থেকে স্পষ্ট, দেশটি নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে একটি জটিল এবং বহুস্তরীয় বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। পরিবর্তন আসলেও, দুর্নীতি, স্বচ্ছতার অভাব, এবং সুশাসনের চ্যালেঞ্জ অগ্রগতির পথে বড় বাধা হিসেবে রয়ে গেছে।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সম্প্রতি ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ বাতিল করে অধ্যাদেশ জারি করেছেন। এতে বলা হয়েছে, আইনটি বাতিল হলেও এর আওতায় চলমান প্রকল্পগুলো চালু থাকবে এবং এই আইনের আওতায় করা চুক্তিগুলো বৈধ বলে গণ্য করা হবে। তবে জনস্বার্থে এই চুক্তিগুলো পর্যালোচনার সুযোগ রাখা হয়েছে। আইনটি বাতিল হলেও এর কার্যক্রম চালু রাখার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করছেন, এই অধ্যাদেশ কার্যত বিগত সরকারের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডকে দায়মুক্তির সুযোগ দিচ্ছে। তারা আরও উল্লেখ করেছেন যে আইনটি দুর্নীতি ও লুটপাটের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
এই আইন বাতিলের ফলে কিছু ইতিবাচক প্রভাব থাকতে পারে, যেমন—দায়মুক্তি তুলে নিয়ে প্রকল্পগুলোর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। তবে আইনটির অধীনে থাকা প্রকল্প ও চুক্তিগুলো বৈধতা পাওয়ায় অনেকে আশঙ্কা করছেন যে, এতে দুর্নীতির দায় নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে যাবে। অতএব, জনস্বার্থে এই চুক্তিগুলো পুনর্বিবেচনার দাবি যৌক্তিক এবং জরুরি।
ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হামলার জন্য তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং একে পূর্বপরিকল্পিত হামলা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এই হামলার পেছনে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে যে, ভারতের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বললেও, বাংলাদেশের ক্ষোভ কমেনি। ঢাকায় এই ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রমাণ করে যে, এটি শুধু সরকারের নয়, বরং জনগণেরও উদ্বেগের কারণ।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি বিতর্ক তুঙ্গে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বিদেশি কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করেছেন যে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রয়েছে। তিনি এই অভিযোগগুলোকে ‘অপপ্রচার’ বলে অভিহিত করেছেন।
তবে, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা স্বীকার করে তিনি বলেছেন, এগুলো সামাজিক আদর্শের প্রতিফলন নয়। এখানে সরকারের আরও স্বচ্ছতা প্রয়োজন। সঠিক পদক্ষেপ না নিলে এই ‘অপপ্রচার’ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
পূর্ব এশিয়ার এক রাষ্ট্রদূতের প্রশ্নে উঠে এসেছে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে নতুন বিতর্ক। সরকার একটি কমিশন গঠন করেছে, যারা সংবিধানের সংস্কার নিয়ে কাজ করছে। তবে সংবিধান পুনর্লিখনের বিষয়টি স্পর্শকাতর এবং ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
সংবিধান পুনর্লিখনের প্রক্রিয়ায় জাতির সকল স্তরের মতামত গ্রহণ করা উচিত। ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হলে তা দেশকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করবে। তবে, এই প্রক্রিয়ায় যে কোনো একপাক্ষিকতা জাতীয় ঐক্যের জন্য হুমকি হতে পারে।
বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান এবং তার পরিবারের বিদেশি সম্পদ জব্দের আদেশ একটি সাহসী পদক্ষেপ। দুদক-এর তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে যে, তারা অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন। এই পদক্ষেপ শুধু একটি গ্রুপের বিরুদ্ধে নয়, বরং অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য একটি বার্তা।
তবে, এমন সিদ্ধান্তের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আইনি প্রক্রিয়ায় কোনো ফাঁকফোকর থাকলে এটি শুধুই একটি প্রতীকী পদক্ষেপ হয়ে থাকবে। দুর্নীতি রোধে শক্তিশালী আইনি কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি।
আসন্ন ভোটার তালিকা প্রকাশ ও আসন পুনর্বিন্যাস নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম ইতিমধ্যেই সমালোচিত। বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধাজনক আসন বিন্যাস করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই নিরপেক্ষ থেকে কাজ করতে হবে, যাতে দেশের ভোটাররা আস্থা রাখতে পারেন।
এখানে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হবে।
দেশের ব্যাংক খাতের বিপর্যয়ে পরিচালকদের ভূমিকা অগ্রাহ্য করা যায় না। শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংক খাতের বিপুল ঋণ বেড়েছে এবং এতে পরিচালকদের যোগসাজশ প্রমাণিত হয়েছে।
দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি কার্যকরী ও স্বচ্ছ ব্যাংকিং ব্যবস্থা জরুরি। এই খাতের সংস্কার না হলে দেশের অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি অনিবার্য।
উপরোক্ত ঘটনাগুলো আমাদের সামনে একটি বাস্তবতা তুলে ধরে যে, দেশের নীতি-নির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে কূটনৈতিক সম্পর্ক, অর্থনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা—সবক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। এসব সমস্যার সমাধানে শক্তিশালী আইনি কাঠামো, কার্যকরী প্রশাসনিক উদ্যোগ এবং সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।