
খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার গাজিরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোল্লা মফিজুল ইসলাম ঠান্ডুর বিরুদ্ধে অনিয়ম- দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ সহ রয়েছে একাধিক মামলা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর আত্মগোপনে চলে যান চেয়ারম্যান মোল্লা মফিজুল ইসলাম ঠান্ডু। তিনি আত্বগোপনে থেকে ইউনিয়ন পরিষদের সকল কর্মকান্ড করেন বলে অভিযোগ রয়েছে । এতে ইউনিয়নবাসী সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত রয়েছেন কিন্তু তাকে এখনো পর্যন্ত অপসারণ করা হয়নি। ফলে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেনা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্যানেল চেয়ারম্যান সোহাগ মুন্সি।
তিনি থানা আওয়ামীলীগের যুগ্ন সাধারন সম্পাদক হওয়ার সুবাদে গত ইউপি নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় দল থেকে বহিষ্কৃত হন। স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মূর্শিদীর আশীর্বাদ থাকায় বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও গাজীরহাট ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে তার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী দলীয় প্রার্থী ছিলেন কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী হেলাল। দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদী গাজীরহাটে সরকারি কিংবা দলীয় কোন প্রোগ্রামে আসলে আওয়ামী লীগের মূল ধারার নেতা-কর্মীদের উপেক্ষা করে ঠান্ডু মোল্লাকে তিনি প্রাধান্য দিতেন এবং তার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করতেন। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পর থেকে ঠান্ডু মোল্লা ব্যক্তিগত দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা শুরু করেন।
শুরু হয় গাজীরহাট ইউনিয়নে তার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার। দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরও এমপি সালাম মুর্শিদীর প্রভাব খাটিয়ে গাজীরহাট ইউনিয়নের মূল ধারার আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করে ফেলেন। এলাকায় তিনি তার ভাই যুবলীগ নেতা হামিম মোল্লা এবং বুলু শেখ মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হন। একের পর এক এলাকায় নানাবিধ অপকর্ম শুরু করেন। প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট, প্রকাশ্যে ঘেরের মাছ লুট, স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মীকে পিটিয়ে হত্যাসহ এলাকায় তার বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে।
এমপি আব্দুস সালাম মুর্শেদীর আস্থাভাজন। আওয়ামীলীগ সরকারের দলীয় প্রভাবশালী চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সরকারী জমি দখল, সরকারী গাছ কর্তন করে বিক্রি,টিআর- কাবিটা প্রকল্পকের কাজ না করে অর্থ আৎসাত,শিক্ষক নিয়োগ,শালিসের নামে টাকা আদায়,গভীর নলকূপ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়,ট্রেড লাইসেন্স,এলজি এসপি প্রকল্প, হাট বাজার, উন্নয়ন তহবিল, উপজেলা পরিষদের বরাদ্দ, ও কর্মসৃজন প্রকল্পসহ সরকারের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়দের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করলেও সরকার দলীয় প্রভাবশালী চেয়ারম্যান হওয়ায় ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না কেউ। সরকারী কর্মকর্তাদের হুমকি ধামকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে চেয়ারম্যানে বিরুদ্বে।
তিনি ইউপি সদস্যদের সঙ্গে কোনো ধরনের সমন্বয় অথবা পরামর্শ ছাড়াই মনগড়া পরিষদ চালাতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতি অর্থবছরে ইউনিয়ন পরিষদের লাখ লাখ টাকা ট্যাক্স উত্তোলন করে সরকারের কোষাগারে টাকা জমা হয়েছে কি না তা পরিষদের কোন সদস্য জানেনা। জন্মনিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্সের টাকার হিসাব না থাকা বিভিন্ন সনদ দিতে সরকার নির্ধারিত ফি ছাড়াও অতিরিক্ত টাকা আদায়, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ, বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ না করিয়ে অর্থ উত্তোলন ও আত্মসাৎ, ইউনিয়ন পরিষদের আয়ের টাকা অ্যাকাউন্টে জমা না করে ইউপি চেয়ারম্যানের নিজে ব্যয় করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
৫ আগষ্ট ছাত্র – জনতার গণঅভ্যুত্থানে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পলায়নের পর বিএনপি’র কর্মীদের উপর হামলা, নাশকতা ও হত্যা মামলা সহ ৫ টি মামলায় আসামি করা হয়েছে আলোচিত এই চেয়ারম্যানকে।
জানা যায়, খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার গাজীরহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোল্লা মফিজুল ইসলাম ঠান্ডু নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ইউনিয়ন পরিষদের কোনো সদস্যের সঙ্গে আলোচনা না করে পরিষদের প্রকল্প ও অর্থ নিজের ইচ্ছামতো খরচ করেন। এর মাধ্যমে অল্প দিনেই মোল্লা মফিজুর ইসলাম ঠান্ডু কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন । খুলনা শহরেও করেছেন বাড়ি বলে অভিযোগ রয়েছে। তার নামে-বেনামে রয়েছে অঢেল সম্পত্তি যা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে। এতোটাই প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের এই চেয়ারম্যান তার বিরুদ্ধে ইউপি সদস্যরা প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের হুমকি-ধামকি প্রদান করেন। চেয়ারম্যানের ও তার লোকজনের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না কোন ইউপি সদস্য। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শুরু করে দিনমজুর, ভিক্ষুক ও খেটে খাওয়া মানুষের কাছ থেকেও অতিরিক্ত ট্যাক্স নিয়েছেন চেয়ারম্যান। তার চাহিদা মতো অর্থ দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা নাগরিক সনদ, ওয়ারিশ কায়েম সনদসহ ইউপির সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
গত ১০ জুলাই দিঘলিয়া উপজেলার গাজীরহাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সামনে গাজিরহাট বাজারের মচন্দপুর মৌজার সরকারি খাস খতিয়ানের জমিতে চেয়ারম্যানের বডিগার্ড ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ন আহবায়ক ও ভূমিদস্যু রুবেল সরদার অবৈধ ভাবে দখল করে মার্কেট নির্মাণ করছিল । এ সংবাদ পেয়ে সহকারী কমিশনার ভূমি দেবাংশু বিশ্বাস ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে অবৈধ দখলকারীদের স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া সময় চেয়ারম্যান মোল্লা মফিজুর ইসলাম ঠান্ডু তাকে ভাঙ্গতে বাঁধা প্রদান করে। সহকারী কমিশনার ভূমি দেবাংশু বিশ্বাস তার কথা আমলে না নিলে তাকে প্রকাশ্যে হুমকি দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সহকারী কমিশনার ভূমি দেবাংশু বিশ্বাসকে দেখে নেবে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে বদলি করবে বলেও হুমকি দেয়।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি উপজেলার কোলা-গাজিরহাট সড়কের ডোমরা গাজীপাড়ায় সড়কের পাশের ৩টি সিরিষ ও ১টি চম্বল গাছ শ্রমিকরা কর্তণ করছে। দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নির্দেশে গাছ জব্দ করে মাঝিরগাতী পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ সুব্রত কুমার বিশ্বাস । এ সময় সেখানে উপস্থিত স্থানীয় বাসিন্দা ও গাজীপাড়া মসজিদের সভাপতি গাজী গিয়াস উদ্দিনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, গাজিরহাট ইউপি চেয়ারম্যান মোল্লা মফিজুল ইসলাম ঠান্ডু’র নির্দেশেই তিনি গাছ কাটছেন। ইউএনওকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব ছিল চেয়ারম্যানের। গাছ বিক্রি করে মফিজুল ইসলাম ঠান্ডু নিয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে গাজীরহাট ইউনিয়ন জুড়ে প্রতিনিয়ত রাস্তার দু পাশের সরকারী গাছ কেটে বিক্রি করা হয় চেয়ারম্যানের নির্দেশেই।
ইউপি চেয়ারম্যান মোল্লা মফিজুল ইসলাম ঠান্ডু সকল বিষয় অস্বীকার করে বলেন, গাজীরহাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সামনে সরকারি খাস খতিয়ানের জমিতে ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ন আহবায়ক রুবেল সরদার মার্কেট নির্মাণ করছে। এর সাথে তিনি জড়িত নয়। রুবেল সরদার তার বডিগার্ড এ কথা স্বীকার করেন তিনি।
তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাসুম বিল্লাহ বলেন, সহকারী কমিশনার ভূমি দেবাংশু বিশ্বাস গাজীরহাটে অবৈধ দখলকারীদের স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানে গেলে মোল্লা মফিজুর ইসলাম ঠান্ডু ভাঙ্গতে বাঁধা প্রদান করেন। বিষয়টি উদ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে চেয়ারম্যানের অনুপস্থিত থাকায় প্যানেল চেয়ারম্যান দিয়ে ইউপি পরিষদ পরিচালিত হচ্ছে। এলাকা বাসীর দাবি দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যানদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ সরকারি কোষাগারে নিয়ে গরীব দুঃখী মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সাধারণ মানুষ।বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরিফুল ইসলাম জানান, শুনেছি চেয়ারম্যানরা অনুপস্থিত রয়েছে এ কারণে প্যানেল চেয়ারম্যানের মাধ্যমে পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
যে সব চেয়ারম্যান ফৌজদারি মামলার আসামি হয়েছেন সে বিষয়ে আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হবে। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে চেয়ারম্যানরা যেহেতু স্থায়ী ভাবে অনুপস্থিত রয়েছেন তাঁদের বিষয় জেলা প্রশাসকের সাথে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
Like this:
Like Loading...
Related