নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার মধ্য নরসিংহপুরে দুই দিনব্যাপী ‘মহতী সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা একটি গভীর সাংস্কৃতিক সংকটের প্রতিফলন। ‘মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি’ প্রাঙ্গণে প্রতিবছর এ মেলার আয়োজন করা হয়, যা কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তবে স্থানীয় মুসল্লি ও ইসলামি দলের আপত্তি এবং হেফাজতে ইসলামের হুমকির মুখে প্রশাসন মেলার অনুমতি বাতিল করে, যা নিয়ে লালন ভক্ত ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
মহতী সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা আয়োজনের জন্য ‘মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি’ কর্তৃপক্ষ যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েছিল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধু, গুরু, এবং লালনভক্তরা এখানে সমবেত হয়েছিলেন। কিন্তু ১৫ নভেম্বর, স্থানীয় ‘তৌহিদি জনতা’ ব্যানারে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ করেন। হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আবদুল আউয়াল মেলাকে ‘ইমানবিধ্বংসী’ আখ্যা দিয়ে প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন মেলার অনুমতি বাতিল করে।
মেলার আয়োজক ফকির শাহ্ জালাল অভিযোগ করেন, তাঁদের প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এমনকি তাঁদের এলাকা ত্যাগ করতেও বাধ্য করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে লালন ভক্তরা শুধু হতাশ নয়, বরং নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক জানান, স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও ইসলামি দলের আপত্তি এবং পুলিশের দেওয়া আইনশৃঙ্খলা অবনতির আশঙ্কার প্রতিবেদন বিবেচনায় মেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত অনেকের মতে মৌলবাদী শক্তির সামনে নতি স্বীকার করার শামিল। নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা রফিউর রাব্বি মন্তব্য করেন, ‘এটি সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সামনে প্রশাসনের আপসরফার উদাহরণ।’
লালন ফকির ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতা ও অহিংসার প্রতীক। তাঁর আধ্যাত্মিক দর্শন সারা বিশ্বের সুফিবাদ ও সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। লালনের গান, তাঁর জীবনদর্শন, এবং তাঁর সাধনার স্থান ‘মহতী সাধুসঙ্গ’ আমাদের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এমন একজন সুফিসাধকের মেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা শুধু লালনভক্তদের জন্য নয়, বরং পুরো জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য একটি আঘাত।
লালন মেলা বন্ধ হওয়া বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে মৌলবাদ ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্বকে সামনে নিয়ে এসেছে। একটি গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনা একটি অশনিসংকেত। যারা লালনের দর্শনের সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা জানেন যে লালনের গান কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় অনুশীলন নয়, বরং এটি মানবতা, সহনশীলতা এবং সম্প্রীতির বার্তা দেয়। কিন্তু কিছু মৌলবাদী শক্তি এটিকে ‘ইমানবিধ্বংসী’ হিসেবে চিত্রিত করছে।
প্রশাসনের দায়িত্ব হলো সকল পক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবেশ বজায় রাখা। দেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে একত্র হয়ে মৌলবাদী চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। লালন ও তাঁর দর্শনের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে বিভিন্ন প্রচারণা চালানো জরুরি। মৌলবাদী শক্তির হুমকির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
লালন মেলার মতো ঐতিহ্যবাহী আয়োজন বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক চর্চার ওপর হুমকি হিসেবে বিবেচিত। এটি মৌলবাদ এবং সংস্কৃতির মধ্যে সংঘাতের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এ ধরনের ঘটনা শুধু সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটায় না, বরং একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের পথেও বাধা সৃষ্টি করে। সমাজের সব স্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এ সংকট থেকে উত্তরণের পথ তৈরি করতে।