বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) ২০২৪ সালে পদ্মাসেতু থেকে সর্বোচ্চ ৮৩৮.৫৬ কোটি টাকা আয় করেছে। পদ্মা বহুমুখী সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাদ নিলয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৬৭ লাখ ৩৬ হাজার ৪৭৮টি যানবাহন এই বছরে সেতু অতিক্রম করেছে এবং টোল আদায়ের মাধ্যমে এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব অর্জিত হয়েছে। পদ্মাসেতু থেকে টোল সংগ্রহের এই সাফল্য দেশের অন্যতম বড় অবকাঠামো প্রকল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্বকে তুলে ধরেছে।
পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পর থেকে দুই বছরেরও কম সময়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) মোট ২ হাজার ৬১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা আয় করেছে। ২০২২ সালের ২৫ জুন যানবাহন চলাচলের জন্য সেতুটি খুলে দেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৫৮ লাখ ৮ হাজার ৯৬৮টি যানবাহন পদ্মাসেতু পার হয়েছে।
পদ্মাসেতু চালুর প্রথম বছরেই দেশীয় অর্থায়নে নির্মিত এই মেগা প্রকল্পের টোল থেকে যে রাজস্ব আয় হয়েছে, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। বিবিএর রাজস্ব আয়ের এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
পদ্মাসেতু নির্মাণের জন্য সরকার বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে এক শতাংশ সুদে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল। ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট অর্থ বিভাগের সঙ্গে বিবিএর চুক্তি অনুযায়ী, এই ঋণ ৩৫ বছরের মধ্যে ১৪০টি কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।
সেতু বিভাগ ২০২৩ সালের ৫ এপ্রিল রাজস্ব আয় থেকে সরকারকে ঋণ পরিশোধ করা শুরু করে। এখন পর্যন্ত বিবিএ ১০টি কিস্তিতে মোট ১ হাজার ৫৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা অর্থ বিভাগকে পরিশোধ করেছে।
পদ্মা বহুমুখী সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাদ নিলয় জানান, “আমরা সাধারণত প্রতি অর্থবছরে চারটি কিস্তি প্রদান করি। প্রতিটি কিস্তিতে ১৫৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা করে পরিশোধ করা হয়।”
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১৪ জুন পদ্মাসেতুতে একদিনে সর্বোচ্চ টোল আদায়ের রেকর্ড হয়েছে। ওইদিন সেতু দিয়ে ৪৪ হাজার ৩৩টি যানবাহন পার হয়েছে এবং টোল আদায় হয়েছে ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
বিশেষ দিন ও উৎসবকেন্দ্রিক যাত্রায় পদ্মাসেতু ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। ফলে সেতুর রাজস্ব আয়ও সেই সময়ে বৃদ্ধি পায়। সরকার আশা করছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী অর্থবছরে পদ্মাসেতু থেকে আরও বেশি রাজস্ব অর্জিত হবে।
বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন থেকে সরে আসার পর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ করে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ছিল ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩০০ কোটি টাকা সরকার অনুদান হিসেবে প্রদান করে এবং বাকি ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে ঋণ হিসেবে প্রদান করা হয়।
এই ঋণের পরিশোধের সময়সূচী অনুযায়ী, প্রতি অর্থবছরে বিবিএকে সর্বনিম্ন ৬৩৪ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। সরকার আশা করছে, পদ্মাসেতু থেকে টোল আদায়ের মাধ্যমে এই ঋণ নির্ধারিত সময়ের আগেই পরিশোধ করা সম্ভব হবে।
পদ্মাসেতু শুধু একটি অবকাঠামো প্রকল্প নয়; এটি দেশের অর্থনীতিতে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। বিশেষত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সেতুটি দেশের পরিবহন খাত, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আঞ্চলিক সংযোগকে ব্যাপকভাবে উন্নত করেছে। এটি দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার করবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, পদ্মাসেতুর টোল আদায় ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক ও কার্যকর করলে রাজস্ব আয় আরও বাড়ানো সম্ভব। বর্তমানে পদ্মাসেতুর টোল আদায় ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজ করার পরিকল্পনা রয়েছে, যা টোল আদায়ের গতিকে ত্বরান্বিত করবে এবং যানবাহনের দীর্ঘ লাইনের সমস্যা কমাবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পদ্মাসেতু থেকে অর্জিত রাজস্ব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং সরকারের বড় প্রকল্পগুলোর ঋণ পরিশোধে সহায়ক হবে।
পদ্মাসেতু বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মেগা প্রকল্প, যা নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে। এই সেতু শুধু দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করেনি, বরং দেশের রাজস্ব আয়ের একটি বড় উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই সরকারকে ঋণ পরিশোধ করতে শুরু করেছে এবং আগামী অর্থবছরগুলোতে রাজস্ব আয় বাড়িয়ে ঋণ পরিশোধের গতি আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। পদ্মাসেতুর সফল ব্যবস্থাপনা ও টোল আদায়ের কার্যকর ব্যবস্থা ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।