বাংলাদেশ রেলওয়ে, দেশের অন্যতম সেবামূলক খাত, দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। অথচ প্রতি বছর এই খাতে বরাদ্দ হয় হাজার হাজার কোটি টাকা, নেওয়া হয় বিশাল বিশাল প্রকল্প। কিন্তু প্রকল্পের কাজ শেষ হলে, যখন জনগণের জন্য সেই সেবাগুলো চালু হওয়ার কথা, তখনই শুরু হয় কালক্ষেপণ ও গড়িমসি। দেখে মনে হয়, পুরো খাতটাই যেন শুধু ‘প্রকল্প নেওয়া’ এবং ‘প্রকল্প বাস্তবায়নের অর্থ আত্মসাৎ’ এর জন্যই টিকে আছে।
জনসাধারণের যাতায়াত সহজ করার লক্ষ্যে আনা হয়েছিল কোটি টাকার ডেমু ট্রেন। আজ সেই ট্রেনগুলো কোথায়? অধিকাংশই জঙ্গল বা স্টেশনের পাশে পড়ে থাকে, ব্যবহৃত হয় না; কিছু ট্রেনের অবস্থা এমন, যেন ওগুলো কোনো সিনেমার পরিত্যক্ত সেট। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, খুচরা যন্ত্রাংশের সংকট, ও অপারেশনাল ব্যর্থতায় জনগণের অর্থ যেন একেবারে জলে ঢেলে দেওয়া হলো।
ডাকঢোল পিটিয়ে নেওয়া হলো মোংলা রেল সংযোগ প্রকল্প। কিন্তু ফাইনাল ট্রায়াল শেষ হতে লাগলো ৮ মাসেরও বেশি। অথচ এখন সারাদিনে চলে মাত্র একটি কমিউটার ট্রেন — সেটাও নিজের রেক নয়। কোনো আন্তঃনগর ট্রেন নেই, পণ্য পরিবহন নেই। শত কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হওয়া রেললাইন এখন অলস পড়ে রয়েছে।
কালুখালি-গোবরা প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষে জনগণ আশা করেছিল একটি কার্যকর রেলযোগাযোগ। বাস্তবে, এখানে চলে শুধু একটি ভাঙাচোরা ট্রেন — টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস। লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্টেশনগুলো কার্যত নির্জন, কেউ যাওয়া-আসা করে না। রাজধানীর সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই। লোকাল ট্রেনের অভাবে স্টেশনগুলো ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে সমাজবিরোধীদের আড্ডাস্থলে।
সবচেয়ে আলোচিত পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প — যার কথা শুনে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল ‘বাংলাদেশে উচ্চ গতির রেল যুগের সূচনা’। কিন্তু বাস্তবতা কী? ট্রায়াল চলেছে ৩৯ মিনিটে, অথচ এখন সেই দূরত্ব পাড়ি দিতে সময় লাগে প্রায় ৮০ মিনিট। মাত্র ২টি আন্তঃনগর ট্রেন চলে, তাও একটিমাত্র রেকে। কথা ছিল প্রতিদিন চলবে ২৪ জোড়া ট্রেন — বাস্তবে সেই কথা এখন লোক দেখানো ঘোষণায় রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকল্পগুলোর দিকে তাকালে স্পষ্ট হয় — প্রকল্পের চেয়ে বাস্তবায়নের পরে সেবা নিশ্চিত করার ইচ্ছেটাই নেই। কোটি কোটি টাকার প্রকল্প যেন নেওয়া হয় কেবল লোক দেখানো উন্নয়ন আর ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। স্টেশনগুলো হয়ে উঠেছে যুবক-যুবতীদের আড্ডাখানা, নেশার আখড়া, বা টিকটক ভিডিও তৈরির হটস্পট — অথচ সরকারের সেবার কথা ছিল জনগণের যাতায়াত সহজ করা।
বাংলাদেশ রেলওয়ে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পরিবহন খাত হলেও দীর্ঘদিন ধরেই নানা অনিয়ম, পরিকল্পনার অভাব, ও সেবার দুর্বলতার কারণে এটি একটি ব্যর্থ সেবামূলক খাতে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হলেও প্রকল্প শেষ হওয়ার পর জনসাধারণ কার্যত কোনো সেবা পায় না। অথচ একটি কার্যকর রেলসেবা কেবল জনগণের যাতায়াত সহজ করে না, এটি অর্থনীতির চাকা সচল রাখে, আঞ্চলিক ভারসাম্য আনে এবং টেকসই পরিবহন নিশ্চিত করে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রেল খাতকে একটি জনকল্যাণমুখী, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক খাতে রূপান্তর করা সময়ের দাবি।
দেশে এমন বহু রেল প্রকল্প রয়েছে, যেখানে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে অবকাঠামো নির্মিত হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের পর মাসের পর মাস ধরে সেবা চালু হয় না। মোংলা রেল সংযোগ প্রকল্প, পদ্মা রেল লিংক, কালুখালি-গোপালগঞ্জ প্রকল্প—এইসব রুটের প্রকল্প কাজ শেষ হওয়ার অনেক পরেও সেখানে ট্রেন চালু হয়নি বা সীমিত পরিসরে চলছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীসেবা চালু না হলে জনগণ প্রকৃত উপকার পায় না এবং রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগও অপচয় হয়। সুতরাং, প্রতিটি প্রকল্পের সঙ্গে একটি টাইমলাইনভিত্তিক অপারেশনাল প্ল্যান সংযুক্ত থাকা বাধ্যতামূলক করা দরকার যাতে জনগণ প্রকল্পের সুফল সময়মতো ভোগ করতে পারে।
বাংলাদেশের বহু রেলপথে লোকাল বা কমিউটার ট্রেন একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ, যারা প্রতিদিন কর্মস্থলে যাতায়াত করেন। মেইন রুটে কিছু আন্তঃনগর ট্রেন থাকলেও, গ্রামাঞ্চল বা উপজেলায় সংযোগের অভাবে যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ছে। এই সংকট মোকাবেলায় ভ্যাকুয়াম রেক বা সেকেন্ডারি কোচ ব্যবহার করে অন্তত ১-২টি লোকাল ট্রেন চালু করা যায়, যা লোকসান না দিয়ে বরং কম খরচে চলতে পারে। এতে জনগণ যেমন উপকৃত হবে, তেমনি রেল কর্তৃপক্ষের আয়ও বাড়বে।
বহু স্টেশন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হলেও সেখানে ট্রেন থামে না, কর্মী নেই, বা কার্যক্রম নেই। ফলে সেসব স্টেশন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে—টিকটকার, মাদকসেবী বা বেকার যুবকদের আড্ডা খানায় পরিণত হচ্ছে। অথচ এসব স্টেশনগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হলে সেগুলোকে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা যেত। রেলওয়ের উচিত স্টেশনগুলোকে মাল্টিপারপাস ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা, যেমন—স্থানীয় পণ্য বিপণন কেন্দ্র, পোস্ট অফিস, তথ্য কেন্দ্র বা পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা। এতে স্টেশন ও স্থানীয় জনজীবন দুই-ই উপকৃত হবে।
দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা, গোপালগঞ্জসহ বিস্তীর্ণ এলাকার জনগণ রেলসেবার ক্ষেত্রে বরাবরই উপেক্ষিত। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের আশ্বাস দেওয়া হলেও সেখানে এখনও পর্যাপ্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি। শুধুমাত্র ১-২টি আন্তঃনগর ট্রেন দিয়ে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলকে পরিবেশন করা কোনোভাবেই যথাযথ নয়। তাই সরকারের উচিত দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিদিন নিয়মিত লোকাল, কমিউটার এবং অন্তত ৪-৫টি আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা। এতে ওই অঞ্চলের জনগণ যেমন উপকৃত হবে, তেমনি ঢাকায় জনস্রোতও কিছুটা কমে আসবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো স্বচ্ছতার অভাব এবং জবাবদিহির ঘাটতি। অনেক সময়ই প্রকল্পের ব্যয় অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যায়, আবার সময়েরও বড়সড় ঘাটতি হয়। কাজ শেষ হলেও কেন ট্রেন চালু হচ্ছে না, কেন যাত্রীসেবা ব্যাহত হচ্ছে—এই প্রশ্নের উত্তর নেই কারো কাছে। এই সংকট নিরসনে রেল মন্ত্রণালয়ে স্বাধীন অডিট ইউনিট, প্রকল্প মনিটরিং সেল এবং জনগণভিত্তিক রেটিং ও অভিযোগ ব্যবস্থাপনা চালু করা উচিত। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের আস্থা ফিরে আসবে এবং রেলের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে শুধুমাত্র একটি পরিবহন মাধ্যম নয়, এটি দেশের আঞ্চলিক ভারসাম্য, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনজীবনের নিরাপদ চলাচলের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হতে পারে। তবে এজন্য দরকার সময়োপযোগী উদ্যোগ, প্রকল্প বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, জনগণের চাহিদা অনুযায়ী ট্রেন চালু, অলস সম্পদের কার্যকর ব্যবহার, এবং সর্বোপরি দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রেল প্রশাসন।
আজ যখন সরকার উচ্চগতির রেল, মেট্রোরেল, বুলেট ট্রেনের মতো বড় বড় স্বপ্ন আঁকছে, তখন বাস্তবভিত্তিক এই প্রশ্ন উঠছে—যা আগে করা হয়েছে তার কি পূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে?
একমাত্র প্রকৃত সেবার মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করলেই বাংলাদেশ রেলওয়ে হতে পারে একটি জনকল্যাণমুখী, লাভজনক ও জাতীয় উন্নয়নের চালিকাশক্তি।