বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে মাথাপিছু ভর্তুকিতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে। কিন্তু বিদ্যুৎ ব্যবহারের দিক থেকে দেশের অবস্থান প্রায় তলানিতে। বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ) এক বিশ্লেষণে জানিয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু বিদ্যুৎ ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ১৮.৫৩ ডলার, যা ভারত, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামের তুলনায় বেশি। অথচ দেশের মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার মাত্র ৫৫৩ ইউনিট, যা এ অঞ্চলে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো উচ্চ উৎপাদন খরচ, দ্রুত অবকাঠামো সম্প্রসারণ, এবং অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি চার্জ। বিদ্যুৎ উৎপাদনে অস্বচ্ছ চুক্তি ও সিদ্ধান্তহীনতা বিদ্যমান সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা সরকারি ভর্তুকির এক-তৃতীয়াংশের বেশি।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের আবাসিক গ্রাহকরা বিদ্যুতের ৫৬% ব্যবহার করেন, যা এ অঞ্চলে সর্বাধিক। অন্যদিকে, শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে ব্যবহারের পরিমাণ মাত্র ৩৯%, যা পাকিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। ফলে শিল্প উৎপাদনে বিদ্যুতের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এ কে এনামুল হকের মতে, বিদ্যুতে ভর্তুকি বৃদ্ধির মূল কারণ হলো দুর্নীতি। তার মতে, পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে স্বাক্ষরিত অনেক চুক্তি ছিল অস্বচ্ছ। বিশেষ করে ইনডেমনিটি আইনের অধীনে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি চার্জের মাধ্যমে কাজ দেওয়া হয়েছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ খাত থেকে কালো টাকা সরবরাহের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।”
অন্যদিকে, সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, আন্তর্জাতিক জ্বালানির উচ্চমূল্য এবং ক্যাপাসিটি চার্জ বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির বোঝা বাড়িয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৫ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ আরও বাড়ানোর প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা আগামী গ্রীষ্মে (মার্চ-সেপ্টেম্বর) ১৮,২৩২ মেগাওয়াট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। যদিও গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর ১০,৬৬৭ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে, সেখান থেকে মাত্র ৬,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ৫,৫৫৮ মেগাওয়াট এবং হেভি ফুয়েল অয়েল (এইচএফও) ভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ৪,১৪৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজন হতে পারে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বকেয়া পরিশোধে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পিডিবি হিমশিম খাচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বকেয়া পরিমাণ প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ৯ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বিআইপিপিএ’র অধীন কেন্দ্রগুলোর।
বিআইপিপিএর সাবেক সভাপতি ইমরান করিম বলেন, “বর্তমানে এইচএফও ভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর সর্বোচ্চ সক্ষমতা ৫,৫২৫ মেগাওয়াট। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে এই ক্ষমতা কমে ৪,০২৫ মেগাওয়াটে নেমে আসবে। তাই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি।” বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদ্যুৎ খাতে খরচ কমাতে স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত বর্তমানে কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের উচ্চ ব্যয়ের কারণে এই খাতটি বড় ধরনের ভর্তুকি নির্ভর হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দুর্নীতি রোধ, উৎপাদন খরচ হ্রাস এবং স্বচ্ছ চুক্তি প্রণয়ন ছাড়া বিদ্যুৎ খাতের এই সংকট নিরসন করা সম্ভব নয়। সঠিক কৌশল এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণই কেবল দেশের বিদ্যুৎ খাতকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে পারে।