
বিডিআর বিদ্রোহের নামে সংঘটিত ২০০৯ সালের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ছিল শেখ হাসিনার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা এবং বিডিআরসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীকে দুর্বল করার একটি পরিকল্পিত পদক্ষেপ— এমনই বিস্ফোরক দাবি করেছেন জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান।
রোববার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর কমিশনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই মন্তব্য করেন। দীর্ঘ ১১ মাসের তদন্ত শেষে ২৪৭ জনের সাক্ষ্য, ৬০০ ঘণ্টার ভিডিও সাক্ষাৎকার, ৮০০টি ছবি, ২১৫টি পত্রিকার প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৯০৫টি চিঠি বিনিময়সহ বিপুল পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়।
কমিশন প্রধান জানান— ২৪৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, শহীদ সেনা সদস্যদের পরিবার থেকে ১৪ জন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ১০ জন, অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা, সামরিক কর্মকর্তা ১৩০ জন, পুলিশ কর্মকর্তা ২২ জন, বিজিবি ও বিডিআর সদস্য ২২ জন, কারাগারে থাকা ২৬ জন, সাংবাদিক ৩ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়
মোট ৬০০ ঘণ্টা ভিডিও সাক্ষাৎকার পর্যালোচনা করা হয়েছে, সংগ্রহ করা হয়েছে ৮০০ ছবির তথ্যভান্ডার। সরকারি-বেসরকারি ২৭টি প্রতিষ্ঠানে পত্র পাঠিয়ে তথ্য নেওয়া হয়েছে।
তদন্তে সেনাবাহিনীর ছয়টি তদন্ত প্রতিবেদন, জাতীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনসহ বিডিআরের ৫২টি তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট সংস্থায় ফেরত পাঠানো হয়েছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কমিশন প্রধান বলেন— “বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা এবং বিডিআরসহ অন্যান্য বাহিনীকে দুর্বল করা।” তিনি দাবি করেন— এ ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই।
তদন্ত কমিশন প্রধান আরও জানান, হত্যাকাণ্ডের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে যাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন— তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকী, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ, ডিজিএফআই প্রধান মেজর জেনারেল আকবর।
তিনি বলেন, ‘‘তদন্তে উঠে এসেছে— এ ঘটনার পেছনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সরাসরি জড়িত ছিল।’’
ফজলুর রহমান জানান— বিদ্রোহের সময় ৯২১ জন ভারতীয় বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। তদন্তে দেখা গেছে— তাদের মধ্যে ৬৭ জনের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এদের সন্ধান বের করার জন্য সরকারকে বিশেষ সুপারিশ করা হয়েছে।
সেনাবাহিনী অভিযান পরিচালনা না করার বিষয়ে তিনি বলেন— ‘‘সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ বলেছিলেন, সেনা অভিযান শুরু করলে ভারত হস্তক্ষেপ করবে এবং ১৯৭১ সালের মতো আর ফিরে যাবে না।’’
তিনি মন্তব্য করেন— যখন ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন, তখন তা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলে।
তদন্তে উঠে এসেছে— বিদ্রোহে শুধু বিডিআর সদস্যই নয়, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বহিরাগত সদস্যরাও অংশ নেয়, ২০–২৫ জনের দল পিলখানায় ঢুকে পরে ২০০ জনের মিছিলে বেরিয়ে যায়, পিলখানায় হামলার সময় হিন্দি ভাষায় কথা বলা ব্যক্তির উপস্থিতিরও প্রমাণ মিলেছে।
ডাল-ভাত কর্মসূচিকে সামনে আনা হলেও এর আড়ালে ছিল বড় ধরনের রাজনৈতিক ও কৌশলগত ষড়যন্ত্র— জানায় তদন্ত কমিশন।