
প্রতিদিন সড়কে প্রাণহানির ঘটনা বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, বছরে গড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান এবং আহত হন কয়েকগুণ বেশি মানুষ। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় নতুন করে একটি সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে প্রথম সড়কসংক্রান্ত আইন প্রণীত হয় ১৯৮৩ সালে ‘মোটর ভেহিক্যাল অর্ডিন্যান্স’ নামে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর ২০১৮ সালে কার্যকর হয় ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’। এর আওতায় ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর জারি হয় ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২’। তবে আইন ও বিধিমালা থাকলেও দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি রোধে এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ।
বর্তমান আইনে মোট ১২৬টি ধারা থাকলেও সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে সরাসরি আলোচনা করা হয়েছে মাত্র দুটি ধারায় (৪৪ ও ৪৯)। দুর্ঘটনায় আহতকে সহযোগিতার কথা বলা হলেও উদ্ধারকারীর জন্য সুনির্দিষ্ট আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিদ্যমান আইন যথেষ্ট নয়।
সরকার ২০২৪ সালের শুরুতে নয় সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে জাতিসংঘ স্বীকৃত ‘সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ’ ভিত্তিতে আধুনিক আইন খসড়া তৈরি করে। এতে নিরাপদ সড়ক, যানবাহন, চালক, গতি নিয়ন্ত্রণ ও দ্রুত চিকিৎসা সেবার বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তবে এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও খসড়া এখনো ফাইলবন্দি। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রাথমিক খসড়া তৈরি হয়েছে এবং শিগগিরই পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও সুশীল সমাজের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর ভাইস চেয়ারম্যান লিটন এরশাদ বলেন, নতুন আইনে প্রতিটি পরিবহনের যাত্রীর বীমা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এছাড়া আহতদের চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য প্রতিটি জেলায় একটি কমিটি গঠন করা দরকার। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আইন প্রণয়ন করলেই হবে না, এর বাস্তবায়নযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই)-এর পরিচালক ড. মো. হাদিউল ইসলাম বলেন, বিদ্যমান আইন প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। নতুন সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণীত হলে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
সরকার জানিয়েছে, ২০২৭ সালের মধ্যে নতুন আইন কার্যকর করার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি ২০২৬ সালের মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় সড়ক দুর্ঘটনা ডেটাবেস চালুর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। বিআরটিএর রোড সেফটি শাখার সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল নোমান জানিয়েছেন, রোড সেফটি অ্যাক্টের খসড়া তৈরি হয়ে গেছে এবং বর্তমানে রিভিউ চলছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রকৃতপক্ষে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সিআইপিআরবি এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, এ সংখ্যা ২৩ হাজারেরও বেশি। অথচ সরকারি পরিসংখ্যান তুলনামূলক কম দেখায়।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণে ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে দুর্ঘটনা কমার বদলে বাড়ছে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়ন ছাড়া বিকল্প নেই।