
বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার আগের তুলনায় কমছে। তবুও এখনো ৫৫টি দেশ এ শাস্তি বহাল রেখেছে। অন্যদিকে মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও বিচারব্যবস্থার আধুনিকায়নের যুক্তিতে বিশ্বের ১১২টি দেশ মৃত্যুদণ্ড পুরোপুরি বা কার্যত বাতিল করেছে। ফলে পৃথিবীর দুই ধরণের দেশের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন তৈরি হয়েছে—যেখানে একটি অংশ মৃত্যুদণ্ড বজায় রাখছে আর অপর অংশ সম্পূর্ণভাবে তা থেকে সরে এসেছে।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে একজন খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। দেশটিতে এটি প্রথমবারের মতো এমন পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর। অপরদিকে জাপান ৩৬ জন নিহত হওয়া অগ্নিসংযোগের একটি মামলায় এক ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। দুটি দেশেই মৃত্যুদণ্ড ব্যবস্থার প্রতি মনোভাব নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশে সম্প্রতি জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছে। পাশাপাশি পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন পানকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই রায় দেশের বিচারব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে।
বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে মাত্র ৯টি দেশ গুরুতর অপরাধে নিয়মিতভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। আরও ২৩টি দেশে আইনগতভাবে মৃত্যুদণ্ড থাকলেও গত ১০ বছরে তা কার্যকর হয়নি।
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের ২০২৫ সালের তালিকা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড বৈধ রয়েছে ৫৫টি দেশে। এর মধ্যে রয়েছে—ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, জাপান, ইরান, সৌদি আরব, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, ভিয়েতনাম, ইরাক, আফগানিস্তান, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরও অনেক দেশ।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসাব অনুযায়ী, চীন প্রতি বছর সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। যদিও দেশটি সরকারি তথ্য প্রকাশ করে না।
চীন বাদ দিলে ২০২২ সালে বিশ্বে ৮৮৩টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। এটি ২০১৭ সালের পর সর্বোচ্চ। ওই বছর অন্তত ২ হাজার ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। একই সময়ে মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত বন্দীর সংখ্যা ছিল ২৮ হাজারের বেশি।
অনেক দেশেই বন্দীরা মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে বছরের পর বছর কনডেমড সেলে অপেক্ষা করে।
২০২২ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে— চীন, ইরান, সৌদি আরব, মিসর, যুক্তরাষ্ট্র।
ইরানে অন্তত তিনটি প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে এবং পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে যখন তারা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন।
অ্যামনেস্টির মতে, নিয়মিতভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে এমন ১১টি দেশ হলো— চীন, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, ইয়েমেন, মিসর। সংস্থাটি মনে করে উত্তর কোরিয়াও নিয়মিতভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে, যদিও তা যাচাই করা কঠিন।
বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ডের একটি বড় অংশ মাদক–সংশ্লিষ্ট অপরাধে হয়। ২০২২ সালে এমন অপরাধে ৩২৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে—এর মধ্যে ২৫৫ জনই ইরানে এবং ৫৭ জন সৌদি আরবে।
সিঙ্গাপুর ২০২৩ সালে প্রায় দুই দশক পর একজন নারী মাদক পাচারকারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে আলোচনায় আসে।
২০২২ সালে ১১২টি দেশ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেনি। একই বছর ছয়টি দেশ পুরোপুরি বা আংশিকভাবে এ শাস্তি বাতিল করেছে—এর মধ্যে রয়েছে কাজাখস্তান, পাপুয়া নিউগিনি, সিয়েরা লিওন, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র।
পাশাপাশি মালয়েশিয়া বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে এবং ঘানা মৃত্যুদণ্ড সম্পূর্ণ বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছে। বর্তমানে ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা এবং ওশেনিয়ার বেশিরভাগ দেশ মৃত্যুদণ্ড রহিত করেছে। বিশ্বে প্রধানত তিন ধরনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়— ফাঁসি, প্রাণনাশী ইনজেকশন, গুলি।
সৌদি আরব এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে শিরশ্ছেদকে মৃত্যুদণ্ড পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষামূলকভাবে নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহারের ঘটনা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে—মৃত্যুদণ্ড মানবাধিকারের পরিপন্থী এবং বিচারব্যবস্থায় ভুল হলে তা সংশোধনের সুযোগ থাকে না। অন্যদিকে কিছু দেশ কঠোর অপরাধ দমনের যুক্তিতে এখনো এই শাস্তি বহাল রেখেছে।
বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বিতর্ক চলমান। একদিকে বাতিল হওয়া দেশের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে কিছু দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের হার আবার বেড়েছে—যা বৈশ্বিক মানবাধিকার অঙ্গনে নতুন প্রশ্ন তৈরি করছে।