বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশন সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, প্রশাসন ও পুলিশ ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আনার জন্য কাজ শুরু করেছে। মোট দশটি সংস্কার কমিশনের মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে সংবিধান ও নির্বাচন সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল, আনুপাতিক ভোটের বিধান চালু, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস এবং এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকার বিধান সংযুক্ত করার মতো প্রস্তাব এসেছে।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল: ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার লক্ষ্যে এই দাবি উঠেছে। প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা চালু: কেন্দ্রীয় শাসনের পরিবর্তে প্রাদেশিক বিকেন্দ্রীকরণকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নারী আসন বৃদ্ধি বা হ্রাস: সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন নিয়ে দুই ধরনের মতামত পাওয়া গেছে।
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, প্রাপ্ত প্রস্তাবনাগুলো সমন্বিত করে এগুলো যাতে পরস্পরবিরোধী না হয় তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। তবে, প্রস্তাবনার বাস্তবায়ন রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করবে।
নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর করার লক্ষ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বিভিন্ন প্রস্তাবনা করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল: ইভিএম নিয়ে বিতর্ক থাকায় এই প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাতিল: এর মাধ্যমে স্থানীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রভাব কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন পরিবর্তন: ভবিষ্যতে সরকারের প্রভাব এড়াতে এই আইন সংস্কারের প্রস্তাব এসেছে। প্রবাসীদের ভোটাধিকার চালু: বিদেশে বসবাসরত নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সংস্কারে প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচনী অপরাধ বন্ধ, স্বচ্ছ ভোটার তালিকা প্রস্তুত এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলোতেও আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি।’
পুলিশ সংস্কারে পুরনো আইনগুলোর পরিবর্তন এনে পেশাদারি বৃদ্ধি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় নিষিদ্ধ: সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য দূর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে গ্রেপ্তার ও রিমান্ড: পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধে এই প্রস্তাব করা হয়েছে। জনকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ: পুলিশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলার জন্য এই সুপারিশ এসেছে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সরফ রাজ হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো আইন দিয়ে পুলিশ চালাচ্ছি। এটি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’
জনপ্রশাসনে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে গঠিত হয়েছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এর উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে, বিকেন্দ্রীকরণ: প্রশাসনিক কার্যক্রম ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে দেওয়া। দুর্নীতি দমন: সরকারি আমলাদের স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাত বন্ধে কঠোর উদ্যোগ। বদলি ও পদায়নে স্বচ্ছ নীতিমালা: সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও বদলিতে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া চালুর প্রস্তাব এসেছে। কমিশনের সদস্য মেহেদী হাসান বলেন, ‘জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য কাঠামোগত পরিবর্তন অপরিহার্য।’
প্রস্তাবনাগুলো চূড়ান্ত করার পর সরকার তা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে। তবে, সংসদ অকার্যকর থাকায় এসব সংস্কার কিভাবে অনুমোদন করা হবে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ গণপরিষদ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন, আবার অনেকে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের অনুমোদনের জন্য অপেক্ষার কথা বলেছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন ছাড়া সংস্কারের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক রীয়াজ বলেছেন, জনগণের সমর্থন পাওয়া প্রস্তাবগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তা দেশের সংবিধান ও প্রশাসনিক কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আনতে পারে। তবে, প্রস্তাবনাগুলোর বাস্তবায়ন রাজনৈতিক দলগুলোর সায় ও জনগণের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল।