হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সৃষ্ট কূটনৈতিক অস্বস্তি নিরসনের উপায় খুঁজতে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর। আগামী সপ্তাহে ওমানের রাজধানী মাস্কাটে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
আগামী ১৬ ও ১৭ ফেব্রুয়ারি ওমানে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ভারত মহাসাগরীয় মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন (৮ম ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্স – আইওসি ২০২৫)। এই সম্মেলনে অংশ নিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই সম্মেলনের সাইড লাইনে উভয়ের মধ্যে একান্ত বৈঠক হবে বলে নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্র।
৫ই আগস্টের সফল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের এটি হবে দ্বিতীয় বৈঠক। এর আগে, গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের সাইড লাইনে নিউ ইয়র্কে তাদের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকের ধারাবাহিকতায় ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি গত ডিসেম্বরে ঢাকা সফর করেন।
সফরটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সফরের শেষে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গেও তিনি বৈঠক করেন। কূটনৈতিক সূত্র মতে, দিল্লি ফিরে তিনি ভারতীয় পার্লামেন্ট কমিটিতে এই সফরের ইতিবাচক বার্তা দেন।
বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতনের পর ৭২ ঘণ্টা সরকারশূন্য অবস্থা বিরাজ করায় রাজনৈতিক কারণে কিছু সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, যা অন্তর্বর্তী সরকারও স্বীকার করেছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে, ভারতের মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হয়, যা দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি করে।
এর মধ্যে ভারতের আগরতলাস্থ সহকারী হাইকমিশনে উগ্রবাদী সংগঠন হিন্দু সংঘর্ষ সমিতির সদস্যরা হামলা চালিয়ে বাংলাদেশের পতাকায় অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া, ভারতের বিভিন্ন শহরেও বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ হয়।
অন্যদিকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে নিয়মিত বক্তব্য দিচ্ছেন, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। সর্বশেষ, গত ৫ই ফেব্রুয়ারি তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এক বক্তৃতায় সরকারের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেন, যা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কেন্দ্র ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ আত্মগোপনে থাকা নেতাদের বাড়িঘরে হামলার সূত্রপাত করে।
৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে বাংলাদেশ সরকার, যার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ৭ই ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে ভারত সরকার। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিও দেয়, যা ঢাকা ‘অপ্রত্যাশিত’ ও ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে।
দুই দেশের সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে মাস্কাট বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। আলোচনা হবে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রসঙ্গে ভুল ও অতিরঞ্জিত তথ্য দূর করা, সাম্প্রতিক কূটনৈতিক টানাপোড়েন নিরসন, ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার বিতর্কিত ভূমিকা, দুই দেশের বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সম্পর্ক স্বাভাবিক করা, নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়বলী।
উভয় পক্ষের আগ্রহ থাকায় এই বৈঠক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। তবে, তা কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করছে আলোচনার ফলাফলের ওপর।