ঢাকার আশেপাশে নগর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নারায়ণগঞ্জের ডিএনডি খাল। এই খাল একসময় শহর ও আশপাশের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সম্পদ ছিল। কিন্তু আজ তা যেন এক দূষণের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন বাসা-বাড়ি ও দোকান থেকে নিক্ষিপ্ত পলিথিন, প্লাস্টিক, এবং অন্যান্য বর্জ্য এই খালের পানি দূষিত করছে এবং এর পরিবেশগত ভারসাম্য বিনষ্ট করছে।
দেশজুড়ে পরিবেশ রক্ষায় মাননীয় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পলিথিন নিষিদ্ধ করতে উদ্যোগ নিয়েছেন। পলিথিন ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, নারায়ণগঞ্জের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার ডিএনডি খালের ক্ষেত্রে তেমন কার্যকর কোনো উদ্যোগ বা অভিযান চোখে পড়ছে না।
ডিএনডি খাল এলাকায় নিয়মিতভাবে প্লাস্টিক এবং পলিথিন জমা হচ্ছে। স্থানীয় জনগণ, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, এমনকি কারখানা থেকে নির্বিচারে বর্জ্য ফেলার কারণে খালগুলির পানি প্রায় অচল হয়ে গেছে। ময়লা জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে প্রশ্ন ওঠে, এত গুরুত্বপূর্ণ একটি জনপদে কেন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না?
ডিএনডি খালে নিয়মিত পরিষ্কার কার্যক্রমের অভাব লক্ষ্য করা যায়। পলিথিন ও বর্জ্য জমে খালের পানি দূষিত হচ্ছে, কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ বা নিয়মিত অভিযান চালানোর অভাব রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি পরিবেশ অধিদপ্তর ও পৌরসভা যদি সম্মিলিতভাবে পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা নেয়, তবে খাল দূষণ কমানো সম্ভব।
ডিএনডি খালের বিভিন্ন অংশ দখল হয়ে যাওয়ার কারণে খালগুলোর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। প্রশাসনের উচিত ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে খালের জমি উদ্ধার করে খালগুলোর প্রাকৃতিক রিবেশ পুনরুদ্ধার করা। দখলমুক্ত হলে খালের প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
খাল দূষণের অন্যতম কারণ জনসচেতনতার অভাব। অনেকেই না জেনে বা বুঝে খালে ময়লা ফেলে দেন, যা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। এ ক্ষেত্রে সচেতনতামূলক প্রচারণা কার্যকর হতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন, সামাজিক সংগঠন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মিলে খাল রক্ষার গুরুত্ব নিয়ে জনসচেতনতা বাড়ালে খাল দূষণ অনেকাংশে হ্রাস পেতে পারে।
ডিএনডি খালগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করতে স্থানীয় প্রশাসনের অধীনে একটি নির্দিষ্ট সময়সূচি নির্ধারণ করা উচিত। মাসিক বা সাপ্তাহিক ভিত্তিতে বড় পরিসরের পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা হলে খালের ময়লা অপসারণ ও পানি দূষণ কমানো সম্ভব। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথেও কাজ করা হলে তারা নিজেরাই পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে উৎসাহী হবে।
পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে এলাকাবাসীকে জানানো প্রয়োজন। এ বিষয়ে নিয়মিত কর্মশালা আয়োজন এবং প্রচারমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। স্কুল ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের স্বেচ্ছাসেবক দল হিসেবে সম্পৃক্ত করে জনসচেতনতা বাড়ানো সম্ভব। এর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবে এবং ভবিষ্যতে পরিবেশ রক্ষায় নিজেদের ভূমিকা রাখতে আগ্রহী হবে।
ডিএনডি খালের দূষণ রোধে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা প্রয়োজন। পলিথিন নিষিদ্ধকরণের আইন কার্যকর করার পাশাপাশি, খালে ময়লা ফেলা বা দখলের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এলাকাবাসীকে খাল রক্ষার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা সম্ভব এবং এর মাধ্যমে তারা আইন মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ হবে।
খাল রক্ষায় স্থানীয় সংগঠনগুলির সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ সচেতনতার লক্ষ্যে তারা নিয়মিত প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় সংগঠনগুলো খালের পাশে ডাস্টবিন স্থাপন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্থানীয় মেম্বার, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান ও পৌরসভা তাদের কার্যক্রমের সাথে সমন্বয় করে খালের পরিবেশ রক্ষা এবং এলাকার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজকে এগিয়ে নিতে পারে।
ডিএনডি খালকে দখল ও দূষণ থেকে মুক্ত করে পুনরায় জীবন্ত খাল হিসেবে ফিরিয়ে আনার জন্য ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে খালগুলো উদ্ধার করা জরুরি। খালগুলির পানি প্রবাহ স্বাভাবিক করার মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসন করা সম্ভব হবে। খালের পাশে বৃক্ষরোপণ ও সবুজায়নের মাধ্যমে এলাকাটিকে আরো মনোরম ও পরিবেশবান্ধব করা যেতে পারে। সৌন্দর্য বৃদ্ধির এই উদ্যোগগুলো শুধু খালের পরিবেশ রক্ষা করবে না; বরং আশেপাশের মানুষকে খাল সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন এবং আগ্রহী করে তুলবে।
ডিএনডি খালের পরিবেশ পুনরুদ্ধার এবং দূষণ রোধে সরকারি, বেসরকারি ও স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পরিবেশ রক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে উদাসীনতা না দেখিয়ে তৎপরতা বাড়ানো সময়ের দাবি। প্রশাসনের সক্রিয় উদ্যোগ এবং জনগণের সচেতনতা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ডিএনডি খালকে বাঁচিয়ে তোলার দায়িত্ব কেবল পরিবেশবিদদের নয়; এ দায়িত্ব আমাদের সবার।