বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রখ্যাত অভিনেত্রী অঞ্জনা রহমান আর নেই। শুক্রবার দিনগত রাত ১টা ১০ মিনিটে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। টানা ১০ দিন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের সিসিইউতে অচেতন অবস্থায় ভর্তি ছিলেন তিনি। তবে আশানুরূপ উন্নতি না হওয়ায় গত বুধবার (১ জানুয়ারি) তাকে বিএসএমএমইউতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু সুস্থ হয়ে আর ফিরলেন না অঞ্জনা।
অঞ্জনা রহমানের জন্ম ঢাকায় একটি সংস্কৃতিমনা পরিবারে। ১৯৬৫ সালের ২৭ জুন তার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল। তার আগ্রহকে উৎসাহিত করতে বাবা-মা তাকে নৃত্যের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে পাঠান। সেখানে তিনি ওস্তাদ বাবুরাজ হীরালালের অধীনে কত্থক নৃত্যের তালিম নেন। নাচে তার প্রতিভা স্বীকৃতি পায় তিনবার জাতীয় পুরস্কার এবং এশিয়া মহাদেশীয় নৃত্য প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জনের মাধ্যমে।
১৯৭৬ সালে বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘সেতু’ সিনেমার মাধ্যমে অভিনয় জীবন শুরু করেন অঞ্জনা। তবে তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ছিল শামসুদ্দিন টগর পরিচালিত ‘দস্যু বনহুর’। এরপর থেকে তিনি একের পর এক সফল সিনেমায় অভিনয় করেন।
অঞ্জনার অভিনীত উল্লেখযোগ্য বাংলা সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘অশিক্ষিত’, ‘জিঞ্জীর’, ‘আনারকলি’, ‘আশার প্রদীপ’, ‘সুখে থাকো’, ‘সানাই’, ‘বৌ কথা কও’, ‘অভিযান’, ‘রাম রহিম জন’, ‘রূপালি সৈকতে’, ‘মোহনা’ এবং ‘পরিণীতা’। তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি ৩০০টিরও বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন।
অঞ্জনা কেবল বাংলাদেশেই নয়, ৯টি দেশের ১৩টি ভাষার সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, তুরস্ক, থাইল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কা। তিনি দাবি করেছিলেন, তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি অভিনেত্রী যিনি ৯টি দেশের এতোগুলো ভাষায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
অঞ্জনা রহমান দেশের জনপ্রিয় প্রায় সব অভিনেতার সঙ্গেই অভিনয় করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন রাজ্জাক, আলমগীর, জসিম, বুলবুল আহমেদ, জাফর ইকবাল, ওয়াসিম, উজ্জ্বল, ফারুক, ইলিয়াস কাঞ্চন, সোহেল চৌধুরী, রুবেল, মান্না প্রমুখ। এছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিঠুন চক্রবর্তী (ভারত), ফয়সাল (পাকিস্তান), নাদীম (পাকিস্তান), জাভেদ শেখ (পাকিস্তান), ইসমাইল শাহ (পাকিস্তান), শীবশ্রেষ্ঠ (নেপাল) এবং ভূবন কেসি (নেপাল)-এর সঙ্গে অভিনয় করেছেন।
অঞ্জনা রহমান তার অসাধারণ অভিনয়ের জন্য একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮১ সালে ‘গাংচিল’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৬ সালে ‘পরিণীতা’ সিনেমায় ললিতা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো একই পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি ‘পরিণীতা’, ‘মোহনা’ এবং ‘রাম রহিম জন’ সিনেমার জন্য তিনবার বাচসাস পুরস্কারও লাভ করেন।
অভিনয়ের পাশাপাশি অঞ্জনা রহমান চলচ্চিত্র প্রযোজনাতেও সক্রিয় ছিলেন। তার প্রযোজিত উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো হলো, ‘নেপালী মেয়ে’ ‘হিম্মতওয়ালী’ ‘দেশ বিদেশ’ ‘বাপের বেটস’, ‘রঙিন প্রাণ সজনী’, ‘শ্বশুরবাড়ি’, ‘লাল সর্দার’ ‘রাজা রানী বাদশা’ ‘ডান্ডা মেরে ঠান্ডা’ ‘বন্ধু যখন শত্রু’।
অঞ্জনা রহমানের মৃত্যুতে চলচ্চিত্র অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সহকর্মী, ভক্ত এবং শুভানুধ্যায়ীরা তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। তার অবদান বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।