প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করছেন, নানা প্রতিবন্ধকতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতায় সরকার কাঙ্ক্ষিতভাবে কাজ করতে পারছে না। এমন অবস্থায় তিনি নিজ দায়িত্বে থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং উপদেষ্টাদের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এসব আলোচনা উঠে আসে। বৈঠকে এক ঘণ্টার নির্ধারিত সভার পর চার ঘণ্টাব্যাপী অনির্ধারিত আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেন।
উপস্থিত উপদেষ্টাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ড. ইউনূস বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে না। সবাই শুধু সমালোচনা করছে। এইভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের জন্য আমি দায় নিতে রাজি নই।”
বিকেলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে—ড. ইউনূস পদত্যাগ করতে পারেন। এ খবরে বিএনপি ও এনসিপির নেতারা দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানান। বিএনপি নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়ে সরকারকে চাপে রাখে, আর এনসিপি নেতারা যমুনায় গিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে পদত্যাগ না করার আহ্বান জানান।
বিএনপি-সমর্থিত আন্দোলনের মুখে থাকা ঢাকা দক্ষিণের মেয়রপ্রার্থী ইশরাক হোসেনও আন্দোলন থেকে সাময়িক সরে আসেন। ছাত্রদল শাহবাগ অবরোধ তুলে নেয়। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়, তবে রাজনৈতিক উত্তেজনা কাটেনি।
বিশেষ বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে ভাষণের খসড়া তৈরি হয়। তাতে নির্বাচন ও সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তবে ড. ইউনূস তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “সব পক্ষের সহযোগিতা ছাড়া এই সরকার চলবে না।”
বৈঠকে অন্তত চারজন উপদেষ্টা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে একমত হন—সরকারের ওপর আস্থা নেই এবং অপবাদ নিয়ে থাকা উচিত নয়। অন্যদিকে কয়েকজন উপদেষ্টা বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারের দায়িত্ব রয়েছে; এখন বিদায় নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান স্পষ্ট করেন, করিডোর বা বন্দর ব্যবস্থাপনার মতো বড় সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সরকার থেকেই আসা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকার এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
ড. ইউনূস বলেন, “আমরা উন্নত ব্যবস্থাপনায় বন্দর পরিচালনা করতে চেয়েছি, অথচ আমাদের দেশ বিক্রির অপবাদ দেওয়া হচ্ছে।”
উপদেষ্টারা জানান, রাজনৈতিক চাপের কারণে কার্যকর প্রশাসনিক কাজ করা যাচ্ছে না। সব কিছুই ‘কুক্ষিগত’ হয়ে পড়েছে। এতে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে এবং নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ড. ইউনূস বলেন, “আমি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে—এমন নির্বাচন চাই না। এতে সারাজীবনের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে, যা আমি নিতে পারি না।”
গত ৯ মাসের কার্যক্রম তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, “অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, এবং সামাজিক বৈষম্য কমাতে আমরা কাজ করেছি। কিন্তু কেউ প্রশংসা করছে না। বরং যেসব ভুল আমরা করিনি, সেগুলোর জন্যও ট্রল করা হচ্ছে।”
এক উপদেষ্টা অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গ তোলেন এবং বলেন, মামলার কারণে সরকারের কিছু করার ছিল না। তবু সরকারকেই দোষ দেওয়া হচ্ছে।
ড. ইউনূস বলেন, “দলগুলোই অনুরোধ করেছিল আমি দায়িত্ব নিই। এখন তারাই আন্দোলনে যাচ্ছে। রাস্তা বন্ধ করছে, অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। এটা দ্বিচারিতা।”
আরেক উপদেষ্টা বলেন, “যারা আমাদের দায়িত্ব দিয়েছে, তারাই সহযোগিতা করছে না। এই পরিস্থিতিতে আমাদের সরেই যাওয়া উচিত।”
জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, “জাতীয় স্বার্থে দূরদর্শী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন।”
নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “বিএনপি ও এনসিপির অধৈর্যের ফলেই পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়েছে।”
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি এবং বাসদের নেতারাও সরকারের ব্যর্থতা, নিরপেক্ষতা, এবং ক্ষমতার সীমা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।